এক টুকরো পাথরকে হাতে নিন। হাতে নিয়ে এটিকে জোরে জোরে ঝাকান, অথবা একটি হাতুড়ি দিয়ে এটিকে জোরে জোরে আঘাত করুন। এটিকে ঝাকানো অথবা হাতুড়ি দিয়ে আঘাত- যেটাই করা হোক না কেন, এটি আপনার কার্যের প্রতি কোনরূপ প্রতিক্রিয়াই প্রদর্শন করবে না। ব্যথা পেয়ে এটি আপনার প্রতি কখনোই তেড়ে আসবে না। আমাদের এত দিনের অভিজ্ঞতা অন্ততঃ সেটাই বলে।
এবার যদি ঐ একই ঘটনা একটা বিড়ালের সাথে ঘটানো হয়, তাহলে বিড়ালটি ভয় পেয়ে হয়ত আপনার হাত থেকে পালানোর চেস্টা করবে নতুবা আত্মরক্ষার তাগিদে আপনাকে উল্টো আক্রমণ করার চেস্টা করবে।
বিড়ালটি আপনার হাত থেকে পালানোর অথবা আপনাকে আক্রমণ করার চেস্টা করলেও পাথর খন্ডটি কেন অনুরূপ আচরণ করে না? যদি আমরা প্রশ্নটির গতানুগতিক উত্তর দিই, তাহলে যে উত্তরটি পাই, সেটি হলঃ পাথর খন্ডটির কোন "প্রাণ" নেই, তাই এটি আপনার কার্যের প্রতি কোন ধরণের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে না। কোন রাগ/অভিমান/ব্যথা পেয়ে তেড়ে আসে না। কিন্তু বিড়ালটির আছে, তাই বিড়ালটি আপনার উপরোক্ত আচরণে কোন না কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে থাকে। একটু বিজ্ঞানসম্মতভাবে বলতে গেলে, পাথর খন্ডটির কোন "চেতনা বা কনসাসনেন্স (consciousness)" নেই, তাই এটি আপনার ক্রিয়ার প্রতি কোনরূপ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে না।
সে না হয় বোঝা গেল, কিন্তু যদি এখন প্রশ্ন করা হয় এই "চেতনা বা কনসাসনেন্স (consciousness)" জিনিসটা কী, এটি আসলে কোথায় থাকে, এটির উৎপত্তিই বা কীভাবে; তাহলে দেখা যাবে "কনসাসনেন্স (consciousness)" নিয়ে আমাদের গতানুগতিক চিন্তাধারার যে সুতোটি, সেটি দীর্ঘ হওয়া শুরু করেছে। সুতোটির শেষ প্রান্তকে ছোয়ার উদ্দেশ্যে কেউ যদি এটির পথ ধরে হাটা শুরু করে, তবে এটি প্রসারিত হয়ে এমন পর্যায়ে পৌছাতে থাকে যে শেষ অবধি এটির কোন কূলকিনারা পাওয়াই সম্ভব হয় না (অন্ততঃ এখন পর্যন্ত আমরা এটির কোন কূলকিনারা পাই নি)।
উপরে উল্লেখিত প্রশ্নগুলোকে আপাতদৃষ্টিতে অতি সহজ ও সরল মনে হলেও প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনো আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গিয়েছে। বিষয়টিকে একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। যদি পাথরখন্ডটিকে আমরা ক্রমাগত বিভক্ত করতে থাকি, তাহলে এক পর্যায়ে এসে আমরা পদার্থ গঠনকারী মৌলিক কণিকাসমূহ যথা ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন পেয়ে থাকি (আমি এর চেয়ে ক্ষুদ্রতম লেভেল "কোয়ার্ক"-এ যাচ্ছি না)। আবার বিড়ালটিকেও ক্রমাগত বিভক্ত করতে থাকলে আমরা একই মৌলিক কণিকাসমূহ ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন পেয়ে থাকি। অর্থাৎ সূক্ষ্মতম পর্যায়ে গিয়ে দেখা যায়, পাথর খন্ড এবং বিড়াল- দু'টোই একই ধরণের মৌলিক কণিকা দ্বারা গঠিত (শুধু পাথরখন্ড এবং বিড়াল নয়, দৃশ্যমান মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুর ক্ষেত্রেই এই কথাটি প্রযোজ্য)। অথচ মজার বিষয় হচ্ছে, একটিতে চেতনা আছে, অন্যটিতে নেই! এর থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে, "চেতনা বা কনসাসনেন্স" বিষয়টি কতটা রহস্যময়! এটি আসলে আমাদের কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি রহস্যময়।
"চেতনা বা কনসাসনেন্স"-এর সুস্পষ্ট সংজ্ঞা এখন পর্যন্ত দেয়া সম্ভব হয় নি। কেউ কেউ মনে করেন, চেতনা বা কনসাসনেন্স হল কোন কিছুর এমন একটি অবস্থা যে অবস্থায় এটি তার চারপাশে কী ঘটে চলেছে, সে সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সাড়া দিয়ে থাকে। কেউ কেউ আবার "চেতনা" দ্বারা কোন জিনিসের নিজস্ব ভিতর ও বাহ্যিক অস্তিত্বের ব্যাপারে সদা জাগ্রত ও সচেতন থাকার অবস্থাকে বুঝিয়ে থাকে। তবে কনসাসনেন্স বা চেতনা যা-ই হোক না কেন, এটি যে "অস্তিত্বশীল/বিরাজমান", সে বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই।
আমরা যদি আমাদের চারপাশের দিকে তাকাই, তবে আমরা চেতনা বা কনসাসনেন্সকে বিভিন্ন মাত্রায় দেখতে পাই। যেমন, একটা মানুষ একটা বানর থেকে বেশি সেল্ফ কনসাস (self conscious) বা আত্মসচেতন। একটা বানর আবার একটা চিতা থেকে বেশি সেল্ফ কনসাস। একটা চিতা একটা সাপ থেকে বেশি সেল্ফ কনসাস। একটা সাপ একটা ব্যাকটেরিয়া থেকে বেশি কনসাস। এভাবে চলতে থাকলে স্বভাবতই প্রশ্ন চলে আসে, এক পর্যায়ে গিয়ে কী চেতনা শূণ্যে হারিয়ে যায় নাকি এটি পদার্থ গঠনকারী সূক্ষ্মতম মৌলিক কণিকাসমূহে (ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনে) গুনগত বৈশিষ্ট্যরূপে (fundamental property) বিদ্যমান থাকে?
উপরের প্রশ্নের দ্বিতীয় সম্ভাবনাটিকে কেউ কেউ হেসে উড়িয়ে দিতে চাইলেও অনেক বিজ্ঞানীই এখন মনে করেন যে "চেতনা হয়ত এই মহাবিশ্বেরই একটা মৌলিক বৈশিষ্ট্য (fundamental property of this universe) এবং পদার্থ গঠনকারী ক্ষুদ্রতম মৌলিক কণিকাসমূহেও এটি অন্তর্নিহিত গুনরূপে বিদ্যমান রয়েছে। অর্থাৎ, ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন তাদের নিজ নিজ জগতে সদা জাগ্রত (they are always conscious in their own world)। ধারণাটিকে একটু সম্প্রসারণ করলে বলা যায়, এই মহাবিশ্ব নিজেই আসলে একটা চেতনশীল বা জাগ্রত সত্তা! (মূলতঃ এই দৃষ্টিকোণ থেকেই বর্তমানে অনেকে সেই বহু প্রাচীন "প্যানসাইকিজম (panpsycism) বা সর্বপ্রাণ মতবাদ"-কে যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য মতবাদ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। এমনকি অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন নিজেও এই মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন)।
কিন্তু ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন কী আসলেই তাদের জগতে জীবন্ত হতে পারে? এটির উত্তর খুজতে হলে আমাদেরকে জানতে হবে ক্ষুদ্রতম স্কেলে এই মহাবিশ্ব কীভাবে কাজ করে। ক্ষুদ্রতম স্কেলের জগতটি আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান বড় বস্তুর জগত যেভাবে আচরণ করে থাকে, তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে আচরণ করে থাকে। এখানে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে অদ্ভুত সব ঘটনা। উদাহরণস্বরূপ, একটি ইলেকট্রনের কথা চিন্তা করুন। নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রনটির নির্দিষ্ট কোন অবস্থান বা পজিশন নেই। একটি ইলেকট্রন কোন একটা মুহূর্তে পরমাণুর ভিতরে এক্সাক্টলি (exactly) কোথায় অবস্থান করে, তা কোনদিনও আমাদের দ্বারা জানা সম্ভব নয়। আরও মজার ব্যাপার হল এটি একই সাথে স্পেসের (space) বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করতে পারে। আমরা যেটি করতে পারি, সেটি হল এটির অবস্থানের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে একটা ডিস্ট্রিবিউশন দিতে পারি (probability distribution)। এরূপ হওয়ার কারণ হল ইলেকট্রনের তরঙ্গরূপী আচরণ। অপরদিকে, ইলেকট্রনের চেয়ে কোটি কোটি গুন বড় একটা ফুটবলের অবস্থানকে আমরা বেশ নিঃখুতভাবেই বর্ণনা করতে পারি। আসলে পরমাণুর জগতে অবস্থান, বেগ, ভরবেগের ধারণাগুলোই অস্পষ্ট, ঝাপসা ও কুহেলিকাপূর্ণ।
ফিরে যাই আগের আলোচনায়। প্রশ্ন হল, যদি ইলেকট্রনের ভিতরে কোনরূপ চেতনা থেকে থাকে, তাহলে এটি কী তার চারপাশের পরিবেশের পরিবর্তনে সাড়া প্রদানে সক্ষম? এটি কী পারে অপর একটা ইলেকট্রনের সাথে ভাবের আদান-প্রদান করতে (ঠিক যেমনটি অন্য কোন চেতনশীল সত্তা যেমন মানুষ অন্য মানুষের সাথে করে থাকে)? এই প্রশ্নের উত্তর বেশ জটিল। তবে একটা ইলেকট্রন যে অন্য একটা ইলেকট্রনের সাথে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে থাকে, সেটি ১০০% সত্য। যেমন, একটা ইলেকট্রনকে অন্য একটা ইলেকট্রনের কাছাকাছি আনলে এটি অপর ইলেকট্রনটিকে বিকর্ষণ করে দূরে ঠেলে দেয়ার চেস্টা করে। এই দূরে ঠেলে দেয়ার ব্যাপারে মূখ্য ভূমিকা পালন করে এদের ভিতরে ক্রিয়াশীল বিকর্ষণ বল। ইলেকট্রনদ্বয়ের ভাবের আদান-প্রদানের জন্য তাদের ভিতরে মানুষের মত কোন ভাষা নেই, কিন্তু রয়েছে "বল (force)" নামক একটা জিনিসের অস্তিত্ব। হয়ত এই বলই তাদের ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যম, তাদের জগতের ভাষা।
এবার অপর বিষয়টিতে আসা যাক। একটা ইলেকট্রন কী তার চারপাশের পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে? উত্তর হল, হ্যাঁ, পারে। ধরা যাক, একটা ইলেকট্রনকে কোন তড়িৎক্ষেত্রের মধ্যে রাখা হল। এই তড়িৎক্ষেত্রের দরুন এটি একটি বল অনুভব করবে। এবার যদি তড়িৎ ক্ষেত্রের মান পরিবর্তন করা হয়, তাহলে এটির উপর ক্রিয়াশীল বলের মানও আলাদা হবে। পরিবেশের পরিবর্তনে ইলেকট্রনটি এখন আর আগের মত আচরণ করবে না, ভিন্নভাবে আচরণ করবে। ঠিক যেমনটি একটি জীবন্ত সত্তা তার চারপাশের পরিবেশের পরিবর্তনে কখনো কখনো ভিন্ন আচরণ প্রদর্শন করে থাকে। ইলেকট্রনটি কী তাহলে তার নিজ জগতে একটা জাগ্রত সত্তার ন্যায় অস্তিত্বশীল রয়েছে?
আধুনিক কোয়ান্টাম মেকানিক্সের দু'টো বড় রহস্য হচ্ছে "মেজারমেন্ট প্রব্লেম (measurement problem)" ও "কোয়ান্টাম এনটেংগলমেন্ট (quantum entanglement)"। প্রথম রহস্যটি আমাদের সামনে প্রথম উন্মুক্ত হয় "ডাবল-স্লিট এক্সপেরিমেন্ট (double slit experiment)"-এর মাধ্যমে। এই এক্সপেরিমেন্টের সার-সংক্ষেপ হল, একটি ইলেকট্রনকে যতক্ষণ না পর্যন্ত কেউ পর্যবেক্ষণ করছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এটি তরঙ্গরূপে আচরণ করে। এটি একই সাথে স্পেসের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করে। যখনই কেউ একে পর্যবেক্ষন করে, তখনই এটি তার তরঙ্গধর্মকে বিলুপ্ত করে পর্যবেক্ষকের সামনে কণারূপে আবির্ভূত হয়। একটা অস্পষ্ট জগত (fuzzy world) থেকে একটা রিয়েলিটি (reality)-এর আবির্ভাব ঘটে। ইলেকট্রনটি প্রকৃতপক্ষে কণা নাকি তরঙ্গ, সেটি জানার জন্য বিভিন্নরকম চালাকি করে বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্টও সম্পন্ন করা হয়েছে, কিন্তু প্রত্যেকবারই একই ফলাফল পাওয়া গিয়েছে। অর্থাৎ ইলেকট্রনটি কোন না কোনভাবে জেনে ফেলেছে যে তাকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে কি হচ্ছে না এবং লাস্ট পর্যন্ত এটি সে অনুযায়ীই আচরণ করেছে। এ যেন একটা মানুষের সাথে অপর মানুষের "লুকোচুরি (hide and clap)" খেলা। কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় ইলেকট্রনের এরূপ তরঙ্গধর্ম থেকে কণাধর্মে আসাকে বলা হয় "ওয়েভ ফাংশন কলাপসিং (collapse of the wave function)/তরঙ্গধর্মের হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়া"। এই ওয়েভ ফাংশনের কলাপস কোথায় ঘটে, কীভাবে ঘটে তা এখনও আমাদের নিকট রহস্যময়। তবে নেপথ্যের কারণ যেটাই হোক না, এটি যে চিত্রটি আমাদের সামনে তুলে ধরে সেটি যা নির্দেশ করছে, তা হল ইলেকট্রনটি যেন একটা জীবন্ত সত্তার ন্যায় আচরণ করছে (হয়ত অদূর ভবিষ্যতে আমরা মেজারমেন্ট প্রব্লেমের সঠিক রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হব)!
এবার দ্বিতীয় রহস্যটিতে আসা যাক- কোয়ান্টাম এনটেংগলমেন্ট (quantum entanglement)। দু'টো এনটেংগলড (entangled) কণা এমনভাবে আচরণ করতে পারে যেন তাদের ভিতর কোন দূরত্ব বা স্পেস (space)-ই নেই। ধরা যাক, এনটেংগলড কণাদ্বয়ের একটি রয়েছে পৃথিবীতে, অপরটি রয়েছে মহাবিশ্বের শেষ প্রান্তে- বিলিয়ন বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে। কেউ যদি পৃথিবীতে অবস্থিত কণার ঘূর্ণন বা স্পিন (spin) পরিমাপ করে আপ (up)/ঘড়ির কাটার বিপরীত দিকে, তবে তৎক্ষণাৎ দ্বিতীয় কণার (যেটি বিলিয়ন বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে) স্পিন হয়ে যাবে ডাউন (down)/ঘড়ির কাটার দিকে। অর্থাৎ প্রথম কণাটি যেন তার স্পিন আপ পরিমাপের খবরটি সাথে সাথেই দ্বিতীয় কণার নিকট পাঠিয়ে দিয়েছে। অথচ আপেক্ষিক তত্ত্বমতে এই মহাবিশ্বের কোন কিছুই আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলতে পারে না। এক্ষেত্রে স্বভাবতই প্রশ্ন চলে আসে, কণাদ্বয় এত দূরে অবস্থান করেও কীভাবে তৎক্ষনাৎ একে অপরের সাথে তথ্যের আদান-প্রদান করছে? কণাদ্বয়ের মধ্যবর্তী স্পেস (space) বা দূরত্ব কী তবে ইল্যুসন বা ভ্রম মাত্র? হয়তবা ভবিষ্যতই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে। তবে কণাদ্বয় যে একটি অপরটির সাথে একটা অভিন্ন সুতোয় বাধা, সেটি বলা যেতেই পারে।
উপরের আলোচনা হতে এটা বেশ স্পষ্ট যে, অণু-পরমাণুর জগত বা সাবএটমিক ওয়ার্ল্ডে (subatomic world) একটা প্রোটোটাইপ (prototype) কনসাসনেন্স থাকলেও থাকতে পারে। সেটি সত্য হলে তার মানে দাঁড়ায় যে চেতনা বা কনসাসনেন্স সমস্ত মহাবিশ্ব জুড়েই বিদ্যমান রয়েছে। একটু অত্যুক্তি করে বলা যায়, মহাবিশ্ব নিজেই একটা জাগ্রত সত্তা (living organism), এবং এটি নিজেই নিজের ডিসিশন নিতে সক্ষম। যদি মহাবিশ্ব একটি জাগ্রত সত্তা বা living organism হয়ে থাকে, তবে কেন আমরা এটিকে বুঝতে পারি না? কারণ হল, আমরা এটির একটি ক্ষুদ্রতম অংশ। একটি আর্টিকেল থেকে একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে বিষয়টিকে পরিস্কার করার চেস্টা করছি। আমাদের শরীরের কথা বিবেচনা করা যাক। আমাদের শরীরের পরিপাকতন্ত্রের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো তাদের জগতে সদা জাগ্রত এবং ক্রিয়াশীল। একটি ব্যাকটেরিয়ার কথা চিন্তা করা যাক। এটি দেখছে তার চারপাশে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তুকণা (আমাদের শরীরের কোষ)। কতগুলো বস্তুর (আমরা যে খাবার খাই, সেগুলো) প্রত্যহ আনাগোনা। তার নিকট মনে হতে পারে চারপাশের পরিবেশ অনেকটা ফ্যাকাসে, বিবর্ণ ও সেখানে মাঝেমধ্যে কিছু মৃত বস্তুর আনাগোনা। অথচ বাস্তব সত্য হল গভীর থেকে এটির কোন ধারণাই নেই যে এটির চারপাশে কী ঘটে চলেছে। এমনকি এটি নিজেও জানে না যে এটি একটি বিশাল জীবন্ত সত্তার ভিতরের একটা ক্ষুদ্র অংশে অবস্থান করছে। আপাতদৃষ্টিতে এটির কাছে মনে হতে পারে এটি যার ভিতরে অবস্থান করছে, সেটি মৃত। এই একই চিত্র দেয়া যেতে পারে মহাবিশ্ব এবং আমাদের বেলায়। আপাতদৃষ্টিতে সমগ্র মহাবিশ্বকে আমাদের নিকট নিষ্প্রাণ (inanimate) মনে হলেও বাস্তবে এটি একটি জীবন্ত সত্তা। এজন্য কিছু কিছু বিজ্ঞানী মহাবিশ্বকে বলে থাকেন self aware, autonomous and a big gigantic cosmic brain.
কনসাসনেন্স বা চেতনা সম্পর্কে আমাদের একটা মোটামুটি ধারণা থাকলেও কোন একটা সিস্টেমে এটি কখন দৃশ্যমানরূপে আবির্ভূত হয়, সেটি এখনও রহস্যময়। তবে অনেকেই মনে করেন যে সিস্টেম খুব জটিল হলে সেটিতে কনসাসনেন্স আপনা আপনিই আবির্ভূত হতে পারে। যে সিস্টেম যত সরল, তার কনসাসনেন্সও তত কম (এজন্যই একটা ব্যাকটেরিয়ার কনসাসনেন্স একটা মানুষের কনসাসনেন্স থেকে কোটি কোটি গুন কম)। বিজ্ঞানের ভাষায় এই থিউরিটির আলাদা একটা নাম আছে, এটিকে বলা হয় "Emerging theory". এটি অনেকটা তাপমাত্রার মত। মৌলিকভাবে তাপমাত্রার কোন অস্তিত্ব নেই, একটা অণুর ক্ষেত্রে তাপমাত্রার ধারণা প্রযোজ্য নয়, কিন্তু অনেকগুলো অণুর কম্পনের ফলে বস্তু একটি নতুন বৈশিষ্ট্য লাভ করে, আর সেটি হল তাপমাত্রা। অনুরূপভাবে আমাদের ব্রেইনের একটা নিউরণের বেলায়ও কনসাসনেন্স বিষয়টি ঝাপসা, কিন্তু অনেকগুলো নিউরণ মিলে যখন বিশাল একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করে এবং ইলেক্ট্রিক্যাল সিগনালের মাধ্যমে এই নেটওয়ার্কটি যখন ইনফরমেশন এক্সচেঞ্জ করার সক্ষমতা অর্জন করে, তখন কনসাসনেন্সের আবির্ভাব ঘটতে পারে বলে অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী রজার পেনরোজের মতে, এই ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। তাই কনসাসনেন্সকে বুঝতে হলে আমাদেরকে ভালো করে বুঝতে হবে কোয়ান্টাম জগত (quantum world) কীভাবে কাজ করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এই জগতটি এখন পর্যন্ত আমাদের নিকট বড়ই ঝাপসা, অস্পষ্ট ও সম্ভাব্যতায় পরিপূর্ণ।
পরিশেষে, এই মহাবিশ্ব যদি একটা বিশাল চেতনশীল অভিন্ন সত্তা হয়ে থাকে, তবে এর ভিতরের সবকিছুই একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আজ থেকে তাই আপনি আপনার সবচেয়ে বড় শত্রুটিকেও আপন ভাবতে পারেন, গভীর আলিঙ্গনে তাকে টেনে নিতে পারেন বুকে। দেশ-কাল-সংস্কৃতির গন্ডি পেরিয়ে নিজেকে নিয়ে যেতে পারেন এক অনন্য উচ্চতায়। শেষ করছি মিচিও কাকুর একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে,
"Physicists are made of atoms. A physicist is an attempt by an atom to understand itself".
------------
Ripan Biswas