১।
কোন জাতির কাছে একটা জিনিসের গুরুত্ব বোঝার ভাল উপায় হল- তারা জিনিসটাকে ধর্মের অংশ বানিয়ে ফেলেছে কিনা।
বাংলা লোকসংস্কৃতিতে কলেরার জন্য আলাদা দেবী আছেন। হিন্দুদের ওলাইচণ্ডী, মুসলিমদের ওলাবিবি। জহির রায়হান একে বানিয়েছেন অপদেবী, কিন্তু বাংলাপিডিয়া বলছে ওলাবিবি (বা হিন্দুদের ওলাইচণ্ডী) অনেকটা ক্যাথলিক সাধুদের মত। মহিলাকে মাঝেমধ্যে উপাসনা করলে কলেরা দূরে থাকে।
কলেরার নিষ্ঠুরতার কোন সীমা নেই- রোগ হওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যে শরীরের যাবতীয় পানি সামনে পেছনে দিয়ে বেরিয়ে যায়, চিমশে খোলসটা শুধু পড়ে থাকে। কলেরা হাসপাতালে আড়াই বছর কাজ করার সুবাদে বুড়ো স্যারদের কাছে এর কিছু গল্পগুজব শুনেছি। রাতে বাচ্চার হয়ত কলেরা হয়েছে, মা ভোর সকালে ঘাটে সেই ময়লা কাঁথা ধুতে গেছেন। সেই কাঁথা থেকে রাজ্যের ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়েছে পানিতে। একটু পর পাশের পরিবার থেকেই আরেক মহিলা আসছেন ঘাট থেকে পানি নিতে। এই করে কয়েকদিনের মধ্যে গ্রাম শেষ। তার পরের সপ্তাহে পাশের গ্রাম শেষ। এই ভয়ঙ্কর শত্রুর হাতে থেকে কোন নিস্তার নেই। কলেরার মৌসুম আসলে বছর বছর অ্যাটাক হবেই, গ্রামকে গ্রাম লাশ পড়বেই। এ হাজার বছরের নিয়ম। এই বস্তুকে দেবদেবী না বানিয়ে উপায় নেই।
আমি-আপনি অবশ্য শিক্ষিত লোক, সায়েন্সপত্র জানি, আমরা হয়ত ওলাবিবির কাছে না গিয়ে বিজ্ঞানের কাছে ধর্না দিতে চাইব। কলেরা হচ্ছে সেই রোগগুলোর একটা যেটার বিরুদ্ধে বিজ্ঞান খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। এর কারণ দু’টো। প্রথম কারণ আবাস। এমন অনেক রোগজীবাণু আছে, যেগুলো একটু গা বাঁচিয়ে চললেই অ্যাভয়েড করা যায়। এইডসের জীবাণু থাকে মানুষের দেহের ভেতরে। কাজেই যতক্ষণ আরেকজন মানুষের দেহের ভেতরের কোন বস্তু আপনার দেহের ভেতরে না ঢুকছে, ততক্ষণ এইডস ছড়ানোর ভয় নেই। অন্যদিকে কলেরার জীবাণু থাকে পানিতে। পৃথিবী পৃষ্ঠে যেখানেই পানি আছে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সেখানেই কলেরা আছে। আপনার বাড়ির পাশের পুকুর হয়ত আপনি বুজিয়ে দিতে পারছেন, কিন্তু গোটা বঙ্গোপসাগর ভর্তি কলেরা। কাজেই যতক্ষণ না পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর সেঁচে ফেলার একটা কায়দা বের হচ্ছে ততদিনই কলেরার জয়।
দ্বিতীয় কারণ টিকা। পোলিও কিংবা গুটিবসন্তের মত ভয়াবহ অসুখ আছে যেগুলোকে আমরা ভ্যাক্সিনের আঘাতে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছি। এর কারণ গুটিবসন্তের ভ্যাক্সিন একবার যার গায়ে পড়বে, বাকি জীবন তার আর বসন্তের ভয় নেই। এভাবে প্রত্যেকটা মানুষ যদি ভ্যাক্সিন নাও পায়, মোটামুটি আশি পার্সেন্ট লোক পেয়ে গেলেই রোগ আর ছড়াতে পারবে না। গুটিবসন্ত যাকেই ধরতে যাবে, তাকেই দেখবে ভ্যাক্সিনেটেড- ছড়াতে না পেরে এক পর্যায়ে সে নিশ্চিহ্ন হতে বাধ্য হবে। এইজন্যই আজকাল আর কেউ গুটিবসন্তের টিকা নেয় না। কলেরার হিসাব আলাদা। প্রথম কথা সে থাকে পানিতে, কাজেই নিশ্চিহ্ন সে কোনদিনই হবে না। দ্বিতীয়ত, এই রোগের টিকা নিলে মোটামুটি বছর দু'য়েকের জন্য নিশ্চিন্ত, তারপরই শরীরে প্রতিরোধের মেয়াদ শেষ। কাজেই আপনি যদি টিকা দিয়ে কলেরা ঠেকাতে চান, তাহলে আজ থেকে নিয়ে হাশর পর্যন্ত দেশময় মানুষকে প্রত্যেক দু'বছর অন্তর অন্তর টিকা দিয়ে যেতে হবে। একটা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য এটা কোন কাজের কথা নয়।
অবশ্য কিছুক্ষেত্রে কলেরার ভ্যাক্সিনের আসলেই জুড়ি নেই, যেমন আসন্ন মহামারী ঠেকাতে। দক্ষিণাঞ্চলের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কথা ধরুন। এইটুকু জায়গায় কয়েক লাখ মানুষের বাস। খাবার পানি ঠিকঠাক মত মেইনটেইন করা হচ্ছে কিনা ঠিক নেই। এক বাথরুম হাজারটা পরিবার ব্যবহার করছে। ঘনবসতি আর পানি-পয়ঃনিষ্কাশনের দুরবস্থা কলেরা ছড়ানোর জন্য চমৎকার। এই অবস্থায় দেশের কয়েকজন বুদ্ধিমান বিজ্ঞানী মিলে যেটা করলেন- গণহারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের টিকা দিয়ে দিলেন। ব্যাস, ঐ প্রাথমিক ঝুঁকির সময়টায় ব্যবস্থা নিয়ে নিলে আর অত ভয় নেই। এই জন্য আজ পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ওলা বিবি আসেনি। বাকি পৃথিবীর রেফিউজি ক্রাইসিসগুলোর খবর যারা রাখেন, তারা মানবেন এটা প্রায় অবিশ্বাস্য ব্যাপার। সিরিয়া ইরাক ইয়েমেন সুদান যেখানেই শরণার্থী, সেখানেই কলেরা লাগবেই লাগবে। আমাদের দেশের ক্রাইসিসে সেরকমটা হয়নি। এটা কম কথা নয়।
তো কলেরা যদি সাগরময় থাকে আর ভ্যাক্সিনে না মরে, তাহলে একে ঠেকানোর উপায় কি?
পুকুর-নদী-হাওড়-বিলের পানি সরাসরি খাওয়া বন্ধ করা।
কথাটা বলা যতটা সহজ, বাস্তবায়ন করা ততটাই কঠিন। একটা গ্রামের কালচার যদি হয় পুকুরের পানি সরাসরি খাওয়া, তাহলে তাদেরকে সেই পানি চুলায় ফুটিয়ে বা ট্যাবলেট ফেলে খাওয়ার অভ্যাস করানো মোটেও সহজ নয়। যে প্রভাব মানুষ সরাসরি চোখে দেখে না, সেটাকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে বা সেটার ভয়ে নিজের অভ্যাস পরিবর্তন করতে সে খুব একটা উৎসাহী হয় না। কুমিল্লার গোয়ালমারী বলে একটা জায়গার নলকূপের পানিতে সাংঘাতিক মাত্রার আর্সেনিক পাওয়া গিয়েছিল। হর্তাকর্তারা এলাকার মানুষকে মেঘনার পানি পরিশোধন করে নামমাত্র মূল্যে দেওয়া শুরু করলেন। অনেক পরিবার নলকূপ ছেড়ে এই পরিশোধিত পানিতে চলে গেল বটে, কিন্তু অনেকেই বছরখানেক পর আবার বিষাক্ত নলকূপে ফেরত গেল। স্থানীয় কর্মকর্তাকে আমি জিগেস করেছিলাম এর কারণ কী। উনি বলেছিলেন, অনেকেরই এইরকম নতুন কাজকর্ম করতে গিয়ে একটু ইগোতে বাধে। ইগোটা কীসের বা কি বৃত্তান্ত তা জানি না। কিন্তু সার কথা হল মানুষের অভ্যাস বদলানো মুখের কথা নয়।
এই আপনার কথাই ধরুন- আপনি জানেন ফাস্টফুড খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। কিন্তু খাওয়া তো কই থামাচ্ছেন না।
কোন জাতির কাছে একটা জিনিসের গুরুত্ব বোঝার ভাল উপায় হল- তারা জিনিসটাকে ধর্মের অংশ বানিয়ে ফেলেছে কিনা।
বাংলা লোকসংস্কৃতিতে কলেরার জন্য আলাদা দেবী আছেন। হিন্দুদের ওলাইচণ্ডী, মুসলিমদের ওলাবিবি। জহির রায়হান একে বানিয়েছেন অপদেবী, কিন্তু বাংলাপিডিয়া বলছে ওলাবিবি (বা হিন্দুদের ওলাইচণ্ডী) অনেকটা ক্যাথলিক সাধুদের মত। মহিলাকে মাঝেমধ্যে উপাসনা করলে কলেরা দূরে থাকে।
কলেরার নিষ্ঠুরতার কোন সীমা নেই- রোগ হওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যে শরীরের যাবতীয় পানি সামনে পেছনে দিয়ে বেরিয়ে যায়, চিমশে খোলসটা শুধু পড়ে থাকে। কলেরা হাসপাতালে আড়াই বছর কাজ করার সুবাদে বুড়ো স্যারদের কাছে এর কিছু গল্পগুজব শুনেছি। রাতে বাচ্চার হয়ত কলেরা হয়েছে, মা ভোর সকালে ঘাটে সেই ময়লা কাঁথা ধুতে গেছেন। সেই কাঁথা থেকে রাজ্যের ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়েছে পানিতে। একটু পর পাশের পরিবার থেকেই আরেক মহিলা আসছেন ঘাট থেকে পানি নিতে। এই করে কয়েকদিনের মধ্যে গ্রাম শেষ। তার পরের সপ্তাহে পাশের গ্রাম শেষ। এই ভয়ঙ্কর শত্রুর হাতে থেকে কোন নিস্তার নেই। কলেরার মৌসুম আসলে বছর বছর অ্যাটাক হবেই, গ্রামকে গ্রাম লাশ পড়বেই। এ হাজার বছরের নিয়ম। এই বস্তুকে দেবদেবী না বানিয়ে উপায় নেই।
আমি-আপনি অবশ্য শিক্ষিত লোক, সায়েন্সপত্র জানি, আমরা হয়ত ওলাবিবির কাছে না গিয়ে বিজ্ঞানের কাছে ধর্না দিতে চাইব। কলেরা হচ্ছে সেই রোগগুলোর একটা যেটার বিরুদ্ধে বিজ্ঞান খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। এর কারণ দু’টো। প্রথম কারণ আবাস। এমন অনেক রোগজীবাণু আছে, যেগুলো একটু গা বাঁচিয়ে চললেই অ্যাভয়েড করা যায়। এইডসের জীবাণু থাকে মানুষের দেহের ভেতরে। কাজেই যতক্ষণ আরেকজন মানুষের দেহের ভেতরের কোন বস্তু আপনার দেহের ভেতরে না ঢুকছে, ততক্ষণ এইডস ছড়ানোর ভয় নেই। অন্যদিকে কলেরার জীবাণু থাকে পানিতে। পৃথিবী পৃষ্ঠে যেখানেই পানি আছে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সেখানেই কলেরা আছে। আপনার বাড়ির পাশের পুকুর হয়ত আপনি বুজিয়ে দিতে পারছেন, কিন্তু গোটা বঙ্গোপসাগর ভর্তি কলেরা। কাজেই যতক্ষণ না পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর সেঁচে ফেলার একটা কায়দা বের হচ্ছে ততদিনই কলেরার জয়।
দ্বিতীয় কারণ টিকা। পোলিও কিংবা গুটিবসন্তের মত ভয়াবহ অসুখ আছে যেগুলোকে আমরা ভ্যাক্সিনের আঘাতে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছি। এর কারণ গুটিবসন্তের ভ্যাক্সিন একবার যার গায়ে পড়বে, বাকি জীবন তার আর বসন্তের ভয় নেই। এভাবে প্রত্যেকটা মানুষ যদি ভ্যাক্সিন নাও পায়, মোটামুটি আশি পার্সেন্ট লোক পেয়ে গেলেই রোগ আর ছড়াতে পারবে না। গুটিবসন্ত যাকেই ধরতে যাবে, তাকেই দেখবে ভ্যাক্সিনেটেড- ছড়াতে না পেরে এক পর্যায়ে সে নিশ্চিহ্ন হতে বাধ্য হবে। এইজন্যই আজকাল আর কেউ গুটিবসন্তের টিকা নেয় না। কলেরার হিসাব আলাদা। প্রথম কথা সে থাকে পানিতে, কাজেই নিশ্চিহ্ন সে কোনদিনই হবে না। দ্বিতীয়ত, এই রোগের টিকা নিলে মোটামুটি বছর দু'য়েকের জন্য নিশ্চিন্ত, তারপরই শরীরে প্রতিরোধের মেয়াদ শেষ। কাজেই আপনি যদি টিকা দিয়ে কলেরা ঠেকাতে চান, তাহলে আজ থেকে নিয়ে হাশর পর্যন্ত দেশময় মানুষকে প্রত্যেক দু'বছর অন্তর অন্তর টিকা দিয়ে যেতে হবে। একটা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য এটা কোন কাজের কথা নয়।
অবশ্য কিছুক্ষেত্রে কলেরার ভ্যাক্সিনের আসলেই জুড়ি নেই, যেমন আসন্ন মহামারী ঠেকাতে। দক্ষিণাঞ্চলের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কথা ধরুন। এইটুকু জায়গায় কয়েক লাখ মানুষের বাস। খাবার পানি ঠিকঠাক মত মেইনটেইন করা হচ্ছে কিনা ঠিক নেই। এক বাথরুম হাজারটা পরিবার ব্যবহার করছে। ঘনবসতি আর পানি-পয়ঃনিষ্কাশনের দুরবস্থা কলেরা ছড়ানোর জন্য চমৎকার। এই অবস্থায় দেশের কয়েকজন বুদ্ধিমান বিজ্ঞানী মিলে যেটা করলেন- গণহারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের টিকা দিয়ে দিলেন। ব্যাস, ঐ প্রাথমিক ঝুঁকির সময়টায় ব্যবস্থা নিয়ে নিলে আর অত ভয় নেই। এই জন্য আজ পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ওলা বিবি আসেনি। বাকি পৃথিবীর রেফিউজি ক্রাইসিসগুলোর খবর যারা রাখেন, তারা মানবেন এটা প্রায় অবিশ্বাস্য ব্যাপার। সিরিয়া ইরাক ইয়েমেন সুদান যেখানেই শরণার্থী, সেখানেই কলেরা লাগবেই লাগবে। আমাদের দেশের ক্রাইসিসে সেরকমটা হয়নি। এটা কম কথা নয়।
তো কলেরা যদি সাগরময় থাকে আর ভ্যাক্সিনে না মরে, তাহলে একে ঠেকানোর উপায় কি?
পুকুর-নদী-হাওড়-বিলের পানি সরাসরি খাওয়া বন্ধ করা।
কথাটা বলা যতটা সহজ, বাস্তবায়ন করা ততটাই কঠিন। একটা গ্রামের কালচার যদি হয় পুকুরের পানি সরাসরি খাওয়া, তাহলে তাদেরকে সেই পানি চুলায় ফুটিয়ে বা ট্যাবলেট ফেলে খাওয়ার অভ্যাস করানো মোটেও সহজ নয়। যে প্রভাব মানুষ সরাসরি চোখে দেখে না, সেটাকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে বা সেটার ভয়ে নিজের অভ্যাস পরিবর্তন করতে সে খুব একটা উৎসাহী হয় না। কুমিল্লার গোয়ালমারী বলে একটা জায়গার নলকূপের পানিতে সাংঘাতিক মাত্রার আর্সেনিক পাওয়া গিয়েছিল। হর্তাকর্তারা এলাকার মানুষকে মেঘনার পানি পরিশোধন করে নামমাত্র মূল্যে দেওয়া শুরু করলেন। অনেক পরিবার নলকূপ ছেড়ে এই পরিশোধিত পানিতে চলে গেল বটে, কিন্তু অনেকেই বছরখানেক পর আবার বিষাক্ত নলকূপে ফেরত গেল। স্থানীয় কর্মকর্তাকে আমি জিগেস করেছিলাম এর কারণ কী। উনি বলেছিলেন, অনেকেরই এইরকম নতুন কাজকর্ম করতে গিয়ে একটু ইগোতে বাধে। ইগোটা কীসের বা কি বৃত্তান্ত তা জানি না। কিন্তু সার কথা হল মানুষের অভ্যাস বদলানো মুখের কথা নয়।
এই আপনার কথাই ধরুন- আপনি জানেন ফাস্টফুড খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। কিন্তু খাওয়া তো কই থামাচ্ছেন না।
২।
মানুষ অতি চালু প্রাণী। বিশেষ করে বিজ্ঞানীরা। তারা চিন্তা করলেন- কলেরা তো পরিবেশেরই অংশ। পরিবেশে যখন কোন ধস নামে- ঝড়ঝাপ্টা বন্যা ইত্যাদি হয়- এখন আমরা তো সেটা মোটামুটি আগে থেকেই ধরতে পারি। দক্ষিণের ঝড়তুফানগুলোর জন্য তো ঠিকই বিপদসংকেত আসে। তো সেভাবে কি কলেরার জন্য কোন একটা বিপদসংকেতের ব্যবস্থা রাখা যায় না? তাহলে হয়ত মানুষের অভ্যাস পরিবর্তন করা একটু সহজ হয়।
ব্যাপারটা শুরু হল এভাবে। বিজ্ঞানীরা একদিন খেয়াল করলেন, কলেরার জীবাণুর সাথে শ্যাওলার কীরকম একটা যোগ আছে। বঙ্গোপসাগরের পানিতে যখন শ্যাওলা বাড়ে, দেশে তার কিছুদিন পরে কলেরার একটা ধাক্কা আসে। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যে কী- সেটা নিয়ে কালিক্ষয় কম হয়নি। কেউ বলেন কলেরার জীবাণু শ্যাওলার মধ্যে লুকিয়ে থাকে, কাজেই শ্যাওলা বাড়লে কলেরার প্রকোপ বাড়ে। সে যাই হোক, বিপদসংকেত বানানোর জন্য ব্যাখ্যা আপাতত গুরুত্বপূর্ণ নয়। শ্যাওলার বেশকমের সাথে যে কলেরার সম্পর্ক আছে এটাই গুরুত্বপূর্ণ।
তো সম্পর্কটা যেহেতু আছে, কাজেই এটাকে ব্যবহার করা যাক- সমুদ্রের পানির শ্যাওলা কতখানি থাকলে দেশে কলেরা কতখানি হয়, এরকম একটা হিসাব তো করে ফেলা সম্ভব। তাহলে এরপর যখন ঐ পরিমাণ শ্যাওলা পানিতে আসবে, তখনই দেশময় "কলেরা আসিতেছে - নয় নম্বর বিপদ সংকেত" বলে একটা শোরগোল তুলে ফেলা হবে। মানুষ সারাজীবন না হোক, শুধু ঐ সময়টাতে একটু কষ্ট করে পানিটা ফুটিয়ে কি ট্যাবলেট ফেলে খাবে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো ঠিকমত হাতেপায়ে ধরলে নিশ্চয়ই করবে।
এটা শুনে অনেকটা বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার গল্প মনে হতে পারে- গোটা সমুদ্রের শ্যাওলা মাপা কি মুখের কথা?
আসলে এর একটা আশ্চর্য সহজ উপায় আছে- তার নাম রিমোট সেন্সিং। কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট দিয়ে যে পৃথিবীকে দেখা যায় এটা তো জানেনই। তো এই স্যাটেলাইট আরো একটা মজার ব্যাপার করতে পারে- একটা নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মাধ্যমে পৃথিবীর কোথাও ঠিক কতখানি সালোকসংশ্লেষণ বা ফোটোসিনথেসিস হচ্ছে সেটা বলে দিতে পারে। সালোকসংশ্লেষণের সময় গাছ থেকে খানিকটা শক্তি বের হয়- লিটারেচার সেটাকে বলে chlorophyll fluorescence- সেটা স্যাটেলাইট মোটামুটি ধরতে পারে। সমুদ্রের পানিতে সালোকসংশ্লেষণ ঘটানোর একটা জিনিসই আছে, তার নাম শ্যাওলা। কাজেই রিমোট সেন্সিং করে মাপা সালোকসংশ্লেষণের পরিমাণ যা, পানিতে শ্যাওলার পরিমাণ মোটামুটি তাই।
কলেরা আর শ্যাওলার যোগাযোগ, আর শ্যাওলা মাপার এই বুদ্ধি- এই দুই জিনিস হাতে নিয়ে বিজ্ঞানীরা মাঠে নামলেন। এক গ্রুপ বঙ্গোপসাগরের শ্যাওলা মেপে কখন ভারতের কলকাতা আর বাংলাদেশের চাঁদপুরে কখন কলেরা হবে তার একটা মডেল তৈরি করলেন। দেখা গেল সাগরে শ্যাওলা যখন তুঙ্গে ওঠে, কলকাতায় কলেরার আক্রমণ মোটামুটি ঠিক তখনই হয়। অন্যদিকে চাঁদপুরের হিসাব আলাদা- এখানে কলেরার আক্রমণ আসতে শ্যাওলা তুঙ্গে ওঠার পরেও মাসখানেক দেরি হয়। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বললেন, কলকাতা সাগরের মোটামুটি কাছাকাছি। কাজেই সাগরে যখন শ্যাওলা বাড়ে, তার প্রভাবটা কলকাতার ওপর পড়তে দেরি হয় না। অন্যদিকে চাঁদপুর আরো বেশ খানিকটা ভেতরে, কাজেই সমুদ্রের শ্যাওলার প্রভাবটা এখানে পড়তে মাসখানেক লেগে যায়।
এখান থেকে বোঝা গেল, সমুদ্রের শ্যাওলা দিয়ে কলেরার বিপদসংকেত বানানো হয়ত সম্ভব, কিন্তু তার জন্য খালি শ্যাওলার ওপর নির্ভর করলে হবে না। সমুদ্রের পানি স্থলভাগ থেকে কতটা দূরে, সেই পানির পিঠে চেপে শ্যাওলা আর কলেরার ভেতরে পৌঁছুতে কত সময় লাগছে- এগুলোও জানা গুরুত্বপূর্ণ।
এই ব্যাপারটা বুঝে আরেক গ্রুপ বিজ্ঞানী তাদের নিজেদের একটা মডেল বানানো শুরু করলেন। এই মডেলে শুধু সাগরের শ্যাওলা ছাড়াও আরেকটা জিনিস তারা আমলে নিলেন- river discharge, অর্থাৎ নদী থেকে কীরকম পরিমাণ পানি মাসে মাসে সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে সেই হিসাব। তারা চিন্তা করলেন, যখন নদী থেকে বেশি পানি সমুদ্রে পড়বে, তখন সমুদ্রের শ্যাওলা দেশের ভেতরে ঢুকতে বেগ পাবে। কাজেই কলেরারও দেশে আক্রমণ করতে সময় লাগবে। অন্যদিকে নদীর গতিটা যখন কমে যাবে, তখন সমুদ্র থেকে শ্যাওলা তথা কলেরা দেশে আসবে অপেক্ষাকৃত সহজে।
কিন্তু এখানেও ঐ প্রশ্ন এসে যায়- নদী থেকে কতটা পানি সাগরে পড়ছে, সেটা মাপার উপায় কী? এবারও রিমোট সেন্সিং থাকায় রক্ষে। দেখা গেল, হিমালয়ের পাদদেশে বাতাসের তাপমাত্রার সাথে বাংলাদেশের নদীর গতির একটা যোগ আছে। অর্থাৎ হিমালয়ের ওদিকে বাতাসের তাপমাত্রা মেপে একটু অংক কষলেই সেখান থেকে এই river discharge বের করে আনা যাবে। এই তাপমাত্রা আবার স্যাটেলাইট দিয়ে মাপা যায়।
এবার হিসাব সুন্দর মিলে গেল- বিজ্ঞানীরা দেখলেন, চাঁদপুরে কখন কলেরা হবে তাদের মডেল সেটা মোটামুটি মাস দু'-তিনেক আগে থেকেই বলে দিতে পারছে।
৩।
আমার মতে ওলাইচণ্ডীর প্রকোপ থেকে রক্ষা পাবার মোক্ষম এক উপায় হল এই বিপদসংকেত। তবে এই লাইনে বিজ্ঞানের পদচারণা মাত্র শুরু। এখনও বিজ্ঞানীরা তাদের মডেলগুলো সম্পর্কে অতটা কনফিডেন্ট নন, তারা তাদের মডেলগুলোকে আরো রিফাইন করার চেষ্টা করে চলেছেন। লেখার হালকা চালের সাথে মিল রাখতে গিয়ে আমি সবকিছু খুব সহজ করে বলেছি, কিন্তু এইসব মডেলিং-এর পেছনে হাজার হাজার পাতা পরিসংখ্যান থাকে। পরিসংখ্যান সবসময়ই সম্ভাবনা বলে, কখনোই নিশ্চয়তা দেয় না। এসব ব্যাপার আরো নিখুঁত করে তোলার কাজ চলছে চলবে।
এই গল্পটা থেকে একটা জিনিস লক্ষ্য করা মনে হয় জরুরি। বিজ্ঞানীদের এই বিপদসংকেত যদি শেষ পর্যন্ত সফল হয়, তাহলে বলতেই হবে এটা মোটামুটি যুগান্তকারী একটা ব্যাপার। অথচ পুরো বিজ্ঞানটা কিন্তু হচ্ছে ঘরের ভেতর কম্পিউটারে বসে। আপনাকে না পড়া লাগছে ল্যাবকোট, না যাওয়া লাগছে মাঠে। স্যাটেলাইটের ডেটা গুগল আর্থ সংরক্ষণ করে, তাদের কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া সম্ভব। একইভাবে কলেরার ডেটাও হাসপাতালের রেকর্ড থেকে নেওয়া। এইসব তথ্য-উপাত্ত কিনতে কিছু টাকাপয়সা লাগে বইকি, কিন্তু সেটা পরীক্ষাগারে বা ফিল্ডে গবেষণা চালানোর মত হ্যাপা নয়। রীতিমত বেডরুমে বসে কম্পিউটার গুঁতিয়ে ডেটাকে এদিক সেদিক করেই দেশের একটা চিরাচরিত সমস্যাকে শেষ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
আমাদের মত দেশের জন্য এটা কত সম্ভাবনার একটা ব্যাপার ভেবে দেখেছেন?
এই "বিগ ডেটা" বিপ্লবের দিকে কি তাহলে আমাদের আরেকটু ভালভাবে তাকানো উচিত নয়?
--------------------------------------
তথ্যসূত্র:
কলেরা ভ্যাক্সিন নিয়ে বাংলাদেশে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি কাজ আইসিডিডিআর,বির ফেরদৌসী কাদরী ম্যাডামের। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ভ্যাক্সিন দেওয়ার ব্যাপারটা তার নেতৃত্বেই ঘটেছে। এ ব্যাপারে তার গ্রুপের পাবলিকেশান এখানে: https://
www.thelancet.com/journals/lancet/article/
PIIS0140-6736(18)30993-0/fulltext
কলেরার সাথে শ্যাওলার যোগটা যে আসলে কী, এটা নিয়ে পরীক্ষাগার এবং মাঠ- দুই পর্যায়েই আইসিডিডিআর,বির সিরাজুল ইসলাম স্যার (আমার প্রাক্তন বস) প্রচুর কাজ করেছেন। যারা ব্যাপারটার পেছনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জানতে চান, তারা আমাদের পাবলিশ করা এই গরম গরম পেপারটা দেখতে পারেন: https://
www.sciencedirect.com/science/article/pii/
S0264410X19307959
কলকাতা আর চাঁদপুর মিলিয়ে প্রথম কাজটা বের হয়েছিল ২০০৮ সালে: https://
www.pnas.org/content/105/46/17676 । এই কাজটার সাথে জড়িত ছিলেন আইসিডিডিআর,বির ইউনুস স্যার। ওনার স্পেশালটিই হচ্ছে disease modeling- এর আগেও জলবায়ুর পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে ঢাকা শহরে কলেরা কীভাবে হয়, সে রিসার্চ পাবলিশ করেছেন।
শেষে যে মডেলটার কথা বললাম, শ্যাওলা আর হিমালয়ের তাপমাত্রা মিলিয়ে, সেটা এখানে: https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S1364815213001291
এই শেষের গ্রুপ এখনও এই বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, এই ছোট্ট ভিডিওতে তাদের কথা শুনতে পারেন: https://www.youtube.com/
watch?v=nH-CIDtL5fo
কলেরা ছাড়াও আরো অন্যান্য রোগ ফোরকাস্টিং এর কাজ চলছে বিশ্বব্যাপী। এ ব্যাপারে চমৎকার একটা ইন্ট্রোডাকশান হল এই ভিডিওটা: https://www.youtube.com/
watch?v=oLeDTXnaGkw
Writer: Hassan uz Zaman Shamol