আদম ও হাওয়া জীবনের একদিন

জীববিজ্ঞান


"বিবর্তনের আলোকে না দেখলে জীববিজ্ঞানের কোনোকিছুরই আর অর্থ থাকে না।"

- থিওডসিয়ান ভবঝানস্কি

উক্তিটি জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যতটা সত্য,মানবসমাজকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রেও ততটাই সত্য।

আমাদের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারগুলি তথা আমাদের খাদ্যাভ্যাস, বিবাদ,যৌনতা এসব ব্যাখ্যা করবার জন্যেও কৃষি বিপ্লবের আগেকার দীর্ঘ সময়টা বোঝা প্রয়োজন।বিবর্তনবাদী মনোবিজ্ঞানীরা বলেন যে,আমাদের মস্তিষ্ক ও মনন আজও শিকারি সংগ্রাহক জীবনেরই উপযোগ হয়ে আছে।আমাদের বর্তমান খাদ্যাভ্যাস, বিবাদ,যৌনতা আসলে শিকারি সংগ্রাহক যুগের সাথে শিল্প বিপ্লবোত্তর পরিবেশের এক মিথস্ক্রিয়া।

(০১)

আজকে যত না মানুষ মারা যায় খ্যাদ্যের অভাবের কারণে তার চেয়েও বেশি মানুষ মারা যায় স্থূলতার কারণে।

কখনো চিন্তা করে দেখেছেন,আজও কেনো আমরা উচ্চ ক্যালরিযুক্ত মিস্টি এবং চর্বিজাত খাবার গ্রহণের জন্যে মুখিয়ে থাকি যেখানে আমাদের শরীরের তেমন কোনো উপকারেই আসেনা এসব খাবার।

এ প্রশ্নের উত্তর লুঁকিয়ে আছে আমাদের শিকারি সংগ্রাহক পূর্বপুরুষদের খাদ্যাভাসের মধ্যে।

আগে উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার ছিলো অতি দূর্লভ আর তা কালে ভদ্রে আমাদের পূর্বপুরুষেরা উপভোগ করতে পারতো।আর এই উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার হিসেবে একটিই জিনিস হাতের কাছে ছিলো,তা হলো পাকা ফল।

এখন কেউ যদি তখন এমন কোনো টসটসে পাকা ফলে ভরা গাছের সন্ধান পেতো, তাইলে তার জন্যে বুদ্ধিমানের কাজ হতো বেবুন কিংবা শিম্পাঞ্জির দলে এইখানে হামলে পড়ার আগেই যতটা সম্ভব ফল গলধকরণ করা।

উচ্চ ক্যালরিযুক্ত এই খাবার খাওয়ার প্রবৃত্তি আমাদের জিনে হাজার হাজার বছর ধরে গ্রোথিত হয়ে আছে।আজকের দিনে আমরা যদিও আরামদায়ক বহুতল ভবনে বাস করি,আমাদের ডিএনএ তবু ভাবে আমরা বুঝি বনে জঙ্গলেই ঘুরে বেড়াচ্ছি।তা আমাদের ফ্রিজে পর্যাপ্ত খাবার মজুদ থাকা সত্ত্বেও,কোকের বোতলটা চোখে পড়লেই খিদে না থাকলেও আমরা সাবার করে ফেলি।এ আমাদের দোষ না,আমাদের পূর্বপুরুষদের আদিপাপের ফসল!

এই 'উদরপূর্তি জিন তত্ত্ব' (gorging gene theory) বেশ ব্যাপকভাবেই স্বীকৃত।তবে এরকম অনেক তত্ত্ব প্রচলিত থাকলেও উভয়েই বেশ দূর্বল প্রমাণের য়পর ভিত্তি করে রচিত।

যেমন পারস্পর বিরোধি দুটি তত্ত্ব আছে যার একটি বলে আমাদের পূর্বপুরুষদের পরিবার ছিলো একগামী যার মানে তারা গোষ্ঠিবদ্ধভাবে বসবাস করলেও তাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ছিলো অণু পরিবারের ধারণা।আরেক তত্ত্ব বলে আমাদের পূর্বপুরুষরা গোষ্ঠীবদ্ধভাবেই বাস করতো,অণু পরিবারের অস্তিত্ব ছিলো না।নারী পুরুষ উভয়েই একাধিক সাথি-সঙ্গীর সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হতো।যে শিশুরা জন্ম নিতো তাদের গোষ্ঠীর সবাই মিলেই বড় করতো।যেহেতু কেউই নির্দিষ্টভাবে জানতো না যে কে কার সন্তান তাই তারা সব শিশুকেই সমান চোখে দেখতো,সমান স্নেহ করতো।

আসলেই এই জটিলতা দেখা দেবার অন্যতম কারণ তাদের নিত্যব্যাবহার্য জিনিসের খুব কম জিনিসই আমাদের হাতে এসেছে যার ভিত্তিতে অনুমাণ করাটা বেশ দূরহ।

আজলে আমাদের স্বচ্ছল সমাজের যেকোনো একটা পরিবারের দিকে লক্ষ করলে ফেখা যাবে সেখানে বাড়ি-গাড়ি থেকে শুরু করে ন্যাপকিন ও দুধের কৌটা পির্যন্ত প্রায় লক্ষাধিক জিনিস আছে।এমন কোনো কাজ,বিশ্বাস বা আবেগ নেই যার সাথে বস্তুর সংযোগ নেই।আমাদের খাদ্যাভাসের সাথে জড়িয়ে আছে,চামচ, গ্লাস থেকে শুরু করে বিশাল মালবাহী ট্রাক ও দৈত্যাকার সামুদ্রিক জাহাজ।

আমাদের প্রেম ও যৌনতার সাথে জড়িয়ে আচগে,আংটি, বিচহানা,অন্তর্বাস থেকে শুরু করে দামী রেস্টুরেন্ট,সস্তা মেটাল,বিয়ের জন্যে হলরুম,ক্যাটারিং কম্পানি সহ আরো বহু কিছু।

এমনকি আমাদের প্রার্থণার মতন আধ্যাত্মিক ব্যাপারের সাথে জরিয়ে আছে বস্তুগত জিনিস ততগা চার্ক্স,মসজিদ,মন্দির,প্যাগোডা, ধর্মীয় টেক্সটসমূহ,মোমবাতি,ধূপ-ধূণা আরো কতোকিছু।

অথচ আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনে অধিকাংশ মানসিক,ধর্মীয় ও আবেগ সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো বস্তুনির্ভর ছিলো না যার ফলে আমাদের অনুমাণ এমনকি নূন্যতম ধারণার করবার জায়গাটিও বেশ জটিল আকার ধারণ করেছে।

আর অন্যান্য প্রাণীদের জীবনাচার স্থান-কাল নির্বিশেষে প্রায় একই, সেখানে একই পরিবেশ ও প্রতিবেশে বসবাসকারী মানুষেদের মাঝে বিশাল তফাৎ ছিলো।এর কারণ মূলত ছিলো বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের ফলে ফিকশনের আবির্ভাবের ফলে।যার মাধ্যমে মানুষ কল্পিত বাস্তবতা তৈরিতে সক্ষম হলো।আর ভিন্ন ভিন্ন কল্পিত বাস্তবতায় বিশ্বাসী মানুষেদের গোষ্ঠী একই পরিবেশ ও প্রতিবেশে থাকলেও তাদের জীবনাচারে ছিলো বিস্তর তফাৎ।যেমন,আজকে আমরা দেখি একই প্রতিবেশ ও পরিবেশে বসবাসকারী মানুষেদের শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসের পার্থ্যক্যের কারণে তাদের জীবনাচার ও মূলবোধে বিস্তর তফাৎ লক্ষ্য করা যায়।

তাই মানুষের মতন অগণিত সম্ভাবনাময় জীবের ক্ষেত্রে তার ইতিহাস অনুমাণ করতে মাঝে মাঝে আমাদের বেশ বড়সড় জটিলতার সম্মুখীন হতে হয় যেখানে তাদের নিত্যব্যাবহার্য বস্তুও আমাদের হাতে তেমন নেই।

(২)

কিন্তু একটা কথা আমরা অনেক জোরের সাথেই বলতে পারি যে,তখনকার মানবগোষ্ঠীতে অধিকাংশই ছিলো মানুষ!কথাটা শুনতে বিদঘুটে লাগলেও কৃষি ও শিল্পভিত্তিক সমাজের বেশিরভাগ সদস্য হলো পোষ মানা প্রাণী।এরা প্রভুদের মর্যাদা লাভ না করলেও,এদের সমাজেরই অংশ হয়ে আছে।উদাহারণস্বরূপ বলা যায়,নিউজিল্যান্ড ৪৫ লক্ষ স্যাপিয়েন্স আর পাঁচ কোটি ভেড়ার সমন্বয়ে গঠিত।

তবে একটি সাধারণ ব্যাতিক্রম হিসেবে কুকুরের কথা উল্লেখ করা যায়।কুকুরই স্যাপিয়েন্সের পোষ মানানো প্রথম প্রাণী।আজ থেকে প্রায় ১৫ হাজার বছর আগেও কুকুরের পোষ মানানো নিয়ে অকাট্য প্রমাণ আমাদের কাছে আছে।কুকুর আর মানুষের মাঝে যে ভালোবাসার ও গভীর বন্ধন ১৫ হাজার বছর ধরে টিকে আছে এমন আর কোনো প্রাণীর ক্ষেত্রে ঘটেনি।

(০৩)

আগে গোত্রের মানুষেরা একে অপরে ছিলো অনেক ঘনীষ্ঠ।তাদের জীবন কেটে যেতো আত্মীয় বন্ধুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে।একাকিত্ব ও গোপনীয়তা ছিলো বিরল।অন্যান্য গোত্রের সাথে প্রতিযোগিতা থাকলেও বমধুত্বপূর্ণ সম্পির্ক ছিলো।তবুও মাসের পর মাস কেঁটে গেলেও নিজ গোত্রের বাইরে অন্য কারও সাথে কারও তেমন একটা দেখা হতো না।

জীবন গোত্রের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো।আর বেঁচে থাকার জন্যে গোত্র থেকে বাদ পড়ে যাওয়া মানে মৃত্যুর সামিল ছিলো।(মানুষ কেনো একাকিত্বতার মাঝে হতাশায় ভুগে তার কোনো সূত্র কি পেলেন? চিন্তা করে দেখতে পারেন)

(০৪)

আদিম মানুষের চেয়ে সামষ্টিকভাবে আজ আমরা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে যোজন যোজন এগিয়ে থাকলেও ব্যাক্তি হিসেবে তাদের তুলনায় আমাদের জ্ঞান নিতান্তই নগন্য।

তাদের বেঁচে থাকতে হলে তার এলাকার বিস্তারিত মানচিত্র সহ,কোন ফল বিষাক্ত,কোন গাছের ফল উপকারী,কোথায় গেলে বাঘ মামা হামলা করতে পারে থেকে শুরু করে নিজের বস্ত্র, নিজের অস্ত্র এসব নিজেকেই তৈরি করতে হতো।

নিজেদের প্রতিবেশ ও পরিবেশ সম্পর্কে তাদের ছিলো অগাধ জ্ঞান।তাদের নিত্যব্যাবহার্য জিনিস তাদের নিজেদেরই তৈরি করা লাগতো।

ছোট্ট একটা গল্প বলা যায়,খুব সম্ভবত হাভার্ডের উদ্ভিদবিজ্ঞানের এক গবেষক আদিম নৃগোষ্ঠীদের মাঝে গবেষণা চালাতে গিয়ে তাদের জিজ্ঞেস করলেন যে তোমরা যে এই ফলমূল খাও, তা তোমরা জানো কোনটা বিষাক্ত আর কোনটা উপকারী। তখন তারা অবাক হয়ে বলেছিলো যে এসব তারা কেনো জানবে না,এসব তো মামুলি ব্যাপার।অথচ সেই প্রফেসর নিজেই জানতেন না সে গাছ গাছালিগুলোর ব্যাপারে!যে কিনা এই বিষয়ে বাঘা বাঘা ডিগ্রির অধিকারী।

আমরা আজ তাদের কুলাঙ্গার উত্তরপুরুষ, যারা ঘন্টার পর ঘন্টা কম্পিউটার ব্যাবহার করে,মোবাইল ঘাটাঘাটি করে অথচ বেশিরভাগই এটুকুই জানেনা যে এসব কিভাবে তৈরি হয়!

একজন কম্পিউটার প্রকৌশলী,ইতিহাসের শিক্ষক কিংবা কারখানার শ্রমিককে আর কতটুকুই বা জানতে হয়।নিজেদের কাজ সম্পির্কে খুঁটিনাটি জানতে হয় এই যা।কিন্তু বেশিরভাগ অপরিহার্য কাজগুলির জন্যে নির্ভর করতে হয় অভিজ্ঞ লোকদের উপর।

সমষ্টিগত বিচারে আজ আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের চেয়ে ঢের জ্ঞানী হলেও, ব্যাক্তি পর্যায়ে বিবেচনা করলে তাদের জ্ঞানের সাথে আমাদের জ্ঞানের তুলনাই চলেনা।ব্যাক্তি হিসেবে তারা ছিলেন আমাদের চেয়ে ঢের বেশি জ্ঞানের অধিকারী।

এর প্রমাণও মিলেছে যে,আধুনিক স্যাপিয়েন্সদের মস্তিষ্কের গড় আয়তন সংগ্রাহক যুগের পর আসলে কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।

(০৫)

মোটের উপর বিবেচনা করলে আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবন ছিলো আমাদের তুলনায় ঢের আরামদায়ক ও সন্তোষজনক।

বর্তমানে স্বচ্ছল সমাজের একজন মানুষ যেখানে সপ্তাহে ৪০-৪৫ ঘন্টা কাজ করে।উন্নত দেশে যেখানে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৬০ এমনকি ৮০ ঘন্টাতে।

সেখানে আমাদের পূর্বপুরুষেরা সপ্তাহে ৩৫-৪০ ঘন্টা আর উর্বর এলাকায় এর চেয়েও কম সময় খাটতো।আজকে একজন শ্রমিক যেখানে সকালে বাসা থেকে বের হয়ে সারাদিন হাড় ভাঙা খাটুনি খেটে,সন্ধ্যায় বাসায় দিরে কাপড়চোপড় ও থালাবাসন ধুতে হয়।

সেখানে আজ থেকে ৩০ হাজার বছর আগে তাদের পূর্বপুরুষেরা হয়তো সকাল আটটায় সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে ডেরা হতে বের হতো।আশেপাশে ঘুরে ফল মূল কুড়াত।দুপুরের দিকে সবাই মিলে তা একসাথে ভোজন করতো।এরপর হাতে থাকতো অঢেল সময়,যা দিয়ে তারা বাচ্চাদের সাথে খেলতো,নিজেরা আড্ডা দিতো,কিংবা নিছকই অখণ্ড অবসর যাপন করতো।

ফলমূল সংগ্রাহকদের অর্থনীতি বেশিরভাগ মানুষকে কৃষি ও শিল্প সমাজের তুলনায় জীবনকে অনেক বেশি উপভোগ করবার সুযোগ দিয়েছিলো।

তাদের খাবারও ছিলো বিচিত্র।কৃষি যুগের সময় হতেই মানুষ সীমিত ধরণের খাবার খেয়ে জীবন ধারণ শুরু করে।এর আগে তারা কোনো জির্দিষ্ট খাবার উপর নির্ভরশীল ছিলোনা।

চিনে যেখানে একজন কৃষক সকালের নাস্তায় ভাত,মধ্যভোজনেও ভাত আর রাতেও সেই ভাত খেতো।আর ভাগ্য ভালো থাকলে পরেরদিনও একই খাবার পেতো।সেখানে তাদের পূর্বপুরুষেরা হয়তো সকালে নাস্তা হিসেবে খেতো পাকা আঙুর আর মাশরুম,দুপুরে ফল,শামুক আর কাছিমের ফ্রাই।রাত্রে খরগোসের স্টেক আর বুনো পেঁয়াজ।যার ফলে তারা ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে ভুগতও কম।

আর খরা দেখে দিলেও তেমন সমস্যায় পড়তো না তারা।কোনো নির্দিষ্ট খাবার তথা,ভাত,আঁটা,গম ইত্যাদির প্রতি নির্ভরশীল না থাকায় খরা দেখা দিলে খাদ্যাভাবে পরে সমস্যায় পড়লেও খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে পারতো।খাদ্যের অভাবে মারা পড়তো না।

তাদের সমাজে রোগ জীবাণুর সংক্রমণও কম ছিলো।বেশিরভাগ সংক্রামণ ব্যাধি তথা,জলবসন্ত,হাম,যক্ষা এসব কৃষি ও শিল্পভিত্তিক সমাজে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।যার উৎপত্তি মূলত গৃহপালিত পশুর শরীরেই।

আদিম ফলমূল সংগ্রাহীরা শুধু মাত্র কুকুরকে পোষ মানিয়েছিলো বলেই তারা এসব রোগের কবল থেকে মুক্ত ছিলো।

আর কৃষিভিত্তিক সমাজ ছিলো ঘিঞ্জি অস্বাস্থ্যকর। যেখানে শিকারী সংগ্রাহকদের মুক্ত পরিবেশে মহামারীর প্রকোপ সম্ভবপর ছিলো না।(উল্লেখ্যা কৃষি বিপ্লবের আগে সারা পৃথিবীর জনসংখ্যা ঢাকার অর্ধেকেরও কম ছিলো, অর্থাৎ ৭০-৭৫ লক্ষের মতন)

Writer: Labib Hassan

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম