স্কুলকলেজের জীববিজ্ঞান পাঠ্যপুস্তকে অ্যালিল কথাটার একটা সহজ সংজ্ঞা থাকে। একই জিনের বিভিন্নরূপকে ঐ জিনের অ্যালিল বলে। যেমন বড়হাতের টি আর ছোটহাতের টি হচ্ছে লম্বা-জিনের দুই অ্যালিল
এই লেখাটার উদ্দেশ্য অ্যালিল জিনিসটা নিয়ে আর দু'লাইন কথাবার্তা বলা। আমি মনে করি এর মধ্যে বেশ খানিকটা মজা আছে, পাঠ্যবইয়ের ম্যাড়ম্যাড়ে বর্ণনায় সেটা অতটা ধরা পড়ে না।
প্রথমে অ্যালিলের সংজ্ঞা নিয়ে একটু কথা বলা দরকার। পাঠ্যবইয়ের কথা ঠিক, একটা সময় জীববিজ্ঞানীরা আসলেই অ্যালিল বলতে একটা জিনের বিভিন্ন রূপকে বুঝতেন। এই অর্থ এখনও চলতে ফিরতে ব্যবহৃত হয়।
কিন্তু এরকম সংজ্ঞার একটা সমস্যা আছে।
পরীক্ষায় নকল করলে কি ছাত্রত্ব বাতিল হওয়া উচিত?
এই প্রশ্নটা আপনার কাছে অদ্ভুত লাগতে পারে। প্রশ্নটার সমস্যা হল, "নকল" কথাটা বলতে অনেক কিছু বোঝায়। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের জনের খাতা থেকে টুক করে একটা উত্তর দেখে নেওয়াও নকল, বেঞ্চিতে উত্তর লিখে রাখাও নকল, এমনকি শিক্ষককে ভীতি প্রদর্শন করে আগেভাগে প্রশ্নপত্র হাতিয়ে নেওয়াকেও টেনেটুনে এক ধরণের নকল বলা যেতে পারে। শেষোক্ত অপরাধের জন্য ছাত্রত্ব বাতিল করা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কেবল পরীক্ষার হলে এদিক ওদিক করার জন্য এরকম শাস্তি অনেকের কাছেই অতিরিক্ত মনে হবে। কাজেই কী প্রক্রিয়ায় নকলটা করা হচ্ছে, সেটা নির্দিষ্ট না করা পর্যন্ত প্রশ্নটা অস্পষ্ট থেকে যাবে।
অ্যালিলের সংজ্ঞা যদি বলা হয় "জিনের বিভিন্ন রূপ"- তাহলে সেরকমই একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়। কারণ জিনের ভিন্নতার বেশ কয়েকরকম চেহারা আছে। একেকরকম ভিন্নতা সৃষ্টির প্রক্রিয়া, ফলাফল, পরিণতি ইত্যাদি সম্পূর্ণ আলাদা। কাজেই এদের সবাইকে একসাথে করে আলোচনা করাটা একটু স্থূল।
মনে করুন নিচের চারটা বাক্য হচ্ছে একই জিনের চার অ্যালিল বা ভিন্নরূপ-
১- আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি
২- আমার সোনাড় বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি
৩- আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালবাসি
৪- আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় অনেক ভালবাসি
চারটা "অ্যালিল" ভিন্ন বটে, কিন্তু সব ভিন্নতা এক নয়। ২ এর ক্ষেত্রে পার্থক্য শুধু একটা বর্ণে- বোঝাই যাচ্ছে র লেখার সময় শিফটে চাপ পড়ে ডয়ে শূন্য-র হয়ে গেছে। এটা একধরণের ভিন্নতা। দেখতে হয়ত একটু অদ্ভুত লাগছে, কিন্তু ঘুরেফিরে এটা বানাম ভূল বই কিছু নয়। নেহায়েতই সামান্য।
কিন্তু তিন আর চার নম্বর অ্যালিলের ক্ষেত্রে ভিন্নতা আরেকটু সিরিয়াস। তিন নম্বরে মাঝখান থেকে একটা শব্দ (আমি) উধাও হয়ে গেছে। চার নম্বরে খামোখা একটা নতুন শব্দ যোগ হয়েছে।
অর্থাৎ সবরকম ভিন্নতা কিন্তু এক পর্যায়ের নয়। একই কথা জিনের মধ্যে ভিন্নতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। হয়ত একই জিনের দু'টো অ্যালিলের মধ্যে পার্থক্য শুধু একটা অক্ষরে। আবার এমনও হতে পারে, হয়ত একটা অ্যালিলের মধ্যে এমন খানিকটা অংশ আছে, যেটা অন্যটাতে নেই। এই সবকিছুকে যদি আপনি শুধু "ভিন্নতা" বলে চালিয়ে দেন- সেটা ঐ পরীক্ষায় নকল ব্যাপারটার মত হয়ে গেল।
এজন্য বিজ্ঞানীরা এখন অ্যালিল বলতে সাধারণভাবে "ভিন্নতা"র পাশাপাশি নির্দিষ্ট করে জিনের মধ্যে কয়েকরকম ভিন্নতার কথা বলেন।
এদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে এক অক্ষরের ভিন্নতা। ঐ র কে ড় লেখা আরকি। জিনের মধ্যে কোন একটা জায়গায় চার ধরণের অক্ষর বসতে পারে- এ, টি, জি, কিংবা সি। একই জিনের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় যদি কারো মধ্যে এ আর কারো মধ্যে টি দেখা যায়- সেটা হল অক্ষরের ভিন্নতা। প্রত্যেক ভিন্ন অক্ষরকে একেক অ্যালিল বলা হবে। মানে গোটা জিনের ভিন্নরূপ না বলে আমরা অ্যালিলের সংজ্ঞা দিচ্ছি জিনের মধ্যে একটা অক্ষরের ভিন্নরূপ দিয়ে।
মোটামুটি এরকম একটা জায়গায় তাই চার ধরণের ভিন্নতা দেখা যেতে পারে- ডিএনএর চার অক্ষরের জন্য। অন্যভাবে বলতে গেলে, প্রত্যেক অক্ষরের জন্য সম্ভাব্য অ্যালিল সংখ্যা চার। অবশ্য মাঝে মধ্যে সেখানে কোন অক্ষরই থাকে না, একটা গ্যাপ থাকে (ধরে নিন- আমা সোনার বাংলা)।
সচরাচর মানুষের জিনের মধ্যে এরকম অক্ষর-পর্যায়ে অ্যালিলের সংখ্যা হয় দুই। অর্থাৎ, জিনের একটা নির্দিষ্ট অক্ষরের ক্ষেত্রে জনসংখ্যায় মোটামুটি দু'ধরণের ভিন্নতা দেখা যায়। হয় এ নয় টি। হয় জি নয় সি। হয় এ নয় সি। হয় সি নয় একটা ফাঁকা জায়গা। মানে ভিন্নতার প্রকৃতি যাই হোক না কেন, ঘুরেফিরে দু'ধরণের অক্ষরই দেখা যায়।
এর কারণ বুঝতে হলে এই ভিন্নতাগুলো কেন সৃষ্টি হয় তা নিয়ে একটু কথা বলতে হবে। জিনের মধ্যে অক্ষর পরিবর্তন হওয়ার প্রক্রিয়াটাকে বলে মিউটেশান। কোন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় একবার মিউটেশান হওয়া খুব সহজ। তো সেই মিউটেশানটা যদি অন্তত কিছু মানুষের মধ্যে স্থায়ী হয়ে যায়- তাহলে ঐ অক্ষরের দু'টো অ্যালিল তৈরি হয়ে গেল। প্রথমে ছিল মনে করুন এ, সেখান থেকে কারো কারো মধ্যে মিউটেশানের কারণে হয়ে গেল টি। ফলে জনসংখ্যার কিছু মানুষের থাকবে এ, কিছু মানুষের টি। অর্থাৎ দু'টো অ্যালিল।
কিন্তু যদি ঐ অক্ষরেই দু'টোর বেশি অ্যালিল তৈরি হতে হয়- তাহলে কী হতে হবে চিন্তা করুন। ঐ একই অক্ষরের ওপর আরো একবার মিউটেশান হতে হবে, এবং সেটা স্থায়ী হতে হবে। মানুষের জিনের মধ্যে একটামাত্র মিউটেশান হয়ে স্থায়ী হওয়াই বেশ ধীর প্রক্রিয়া। তারপর যদি বলেন ঐ অক্ষরের ওপরই আরেকদফা মিউটেশান হয়ে টি কে জি কিংবা সি হয়ে থিতু হয়ে যেতে হবে- সেটা একই জায়গায় পরপর দু'বার বজ্রপাত হওয়ার মত। সম্ভাবনা নেই যে তা নয়, কিন্তু কম। তবে নতুন কিছু গবেষণা বলছে তিন-অ্যালিলবিশিষ্ট অক্ষরভিন্নতার পরিমাণও হয়ত অতটা কম নয়।
এই অক্ষর-পর্যায়ে ভিন্নতা বা অ্যালিলগুলোর একটা গালভরা নাম আছে- সিঙ্গল নিউক্লিওটাইড পলিমরফিজম।
সিঙ্গল নিউক্লিওটাইড মানে ডিএনএর এক অক্ষর। ডিএনএর কোন একটা অক্ষর যদি জনসংখ্যার অন্তত ১% মানুষের মধ্যে ভিন্ন হয়- মানে কারো মধ্যে এ, কারো মধ্যে টি ধরুন- তাহলে সেই ভিন্নতাটাকে বলা হয় সিঙ্গল নিউক্লিওটাইড পলিমরফিজম। সংক্ষেপে স্নিপ।
এখনকার জীববিজ্ঞানে এই স্নিপগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের ডিএনএতে গড়ে প্রত্যেক একহাজার অক্ষর পরপর একটা করে স্নিপ বা ভিন্নতাঅলা অক্ষর আসে। কাজেই আপনার-আমার ডিএনএতে চোখ বন্ধ করে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ লাখ স্নিপ থেকে যেতে পারে।
এরকম অক্ষর-পর্যায়ে ভিন্নতার জন্য অধিকাংশ সময়ই আমাদের বৈশিষ্ট্যের এমন কিছু ভিন্নতা হয় না। কিন্তু বিশেষ করে ফরেনসিক মেডিসিনে এই স্নিপগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম।
যেমনটা একটু আগে বললাম, আমাদের ডিএনএর মধ্যে এরকম গাদাগাদা অক্ষর থাকে যাদের মধ্যে মানুষ থেকে মানুষে ভিন্নতা দেখা যায়। ধরে নিন আপনার ডিএনএ থেকে এই ভিন্ন অক্ষরগুলো নিয়ে একটা বিশাল লিস্ট করা হল। সেক্ষেত্রে কিন্তু আপনার লিস্টের সাথে আর কারোর লিস্টই মিলবে না- এক যমজ ভাই ছাড়া। কয়েকটা স্নিপের জায়গায় মিল হওয়া স্বাভাবিক (যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্নিপের অ্যালিল সংখ্যা মাত্র দু'টো), কিন্তু অনেকগুলো স্নিপ দৈব কারণে পরপর মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা আদৌ নেই।
তার মানে মানুষের ডিএনএর এই স্নিপগুলো আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয়ের একটা "বারকোড" হিসেবে কাজ করতে পারে। ধরে নিন এটা আমাদের জেনেটিক রোল নম্বর। এর মাধ্যমে আমরা অন্য সব মানুষ থেকে আলাদা।
আশা করি এখান থেকে ফরেনসিক মেডিসিনে স্নিপের ভূমিকা আঁচ করতে পারছেন। যদি কোন ব্যক্তির পরিচয় সনাক্ত করার দরকার হয়- যেমন ধরুন খুনখারাবির পর মেঝেতে রক্ত বা চুল-টুল পড়ে থাকলে- তাহলে সেই রক্ত থেকে সম্পূর্ণ ডিএনএর অর্থ বের করার দরকার নেই। ডিএনএ থেকে কিছু অংশ কেটে নিয়ে সেখানকার স্নিপগুলো জেনে নিলেই হবে। সেই স্নিপগুলো এবার সন্দেহভাজন ব্যক্তির স্নিপের সাথে মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, চুল বা রক্ত কি তার কিনা। এটাই হচ্ছে স্নিপ-স্বাতন্ত্র্যের সুবিধা।
অবশ্য পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে আরো হাজার ধরণের জটিলতা আছে, এখানে কেবল মূল ধারণাটুকু বললাম।
কিছু ক্ষেত্রে এই স্নিপগুলো আবার চিকিৎসাক্ষেত্রেও কাজে লাগে। যেমন, ডিএনএর মধ্যে বিশেষ কিছু স্নিপ থাকলে ক্যান্সারের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ব্রেস্ট ক্যান্সারের ক্ষেত্রে দু'টো জিন খুব কুখ্যাত- এদের মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় স্নিপ দেখা গেলে বুঝতে হবে রোগের সম্ভাবনা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি।
আজ থেকে বছর বারো আগে বিজ্ঞানীরা একটা বিশাল গবেষণা প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, তাবৎ পৃথিবীর মধ্যে মানুষে-মানুষে যত ধরণের জেনেটিক ভিন্নতা দেখা যায়, তার একটা পূর্ণাঙ্গ লিস্টি করে ফেলা। যতদূর সম্ভব আরকি। এই কাজের জন্য তারা পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশ থেকে প্রায় আড়াইহাজার মানুষের ডিএনএ ঢুঁড়ে কোটিরকম স্নিপের হদিস বের করেছেন। নিচের ছবিটা দেখুন- প্রত্যেক ভিন্নরঙা গোল চার্ট একেকটা জনসংখ্যা নির্দেশ করে। পৃথিবী থেকে এভাবে ছাব্বিশটা আলাদা আলাদা জনগোষ্ঠীর ওপর তারা কাজ করেছেন।
প্রকল্পটার নাম থাউজ্যান্ড জিনোম প্রজেক্ট।
এই হাজার মানুষের ডিএনএ ছানতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রথমেই যে প্রশ্নটা করেছেন তা হল- কোন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জেনেটিক ভিন্নতা (বলতে পারেন স্নিপ সংখ্যা) সবচেয়ে বেশি?
দেখা গেছে, আফ্রিকার মানুষের মধ্যে জেনেটিক ভিন্নতা পৃথিবীর আর যেকোন অঞ্চলের থেকে বেশি।
এর কারণ বোঝা অবশ্য সহজ। মানুষের আদি নিবাস ছিল আফ্রিকায়। সেখান থেকে উৎপত্তির পর তারা পৃথিবীর অন্যান্য মহাদেশে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়েছে। অর্থাৎ, পৃথিবীর অন্য যেকোন জায়গার চেয়ে আফ্রিকার মানুষ অপেক্ষাকৃত বেশি প্রাচীন। প্রাচীন বলেই তাদের ডিএনএতে মিউটেশানের কারণে এত এত ভিন্নতা সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
মানুষের উৎপত্তির এই ধারণাটাকে বলা হয় আউট অফ আফ্রিকা মডেল। ঘুরে ফিরে আমরা সবাই আসলে আফ্রিকান, কেউ একটু বেশি আর কেউ কম।
তথ্যসূত্র:
স্নিপের ক্ষেত্রে তিনরকম অ্যালিল থাকার সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণাপত্র (আমি এটা পড়ে দেখিনি, প্রথমটুকু পড়ে আলোচনার সাথে সংশ্লিষ্ট মনে হল)- Hodgkinson, A. and Eyre-Walker, A., 2010. Human triallelic sites: evidence for a new mutational mechanism?. Genetics, 184(1), pp.233-241.
ফরেনসিক মেডিসিনে স্নিপের ভূমিকা জানতে এই গবেষণাপত্রটা দেখুন- Budowle, B. and Van Daal, A., 2008. Forensically relevant SNP classes. Biotechniques, 44(5), pp.603-610.
ব্রেস্ট ক্যান্সার নির্ণয়ে স্নিপের সংশ্লিষ্টতা জানতে- Prosperi, M.C., Ingham, S.L., Howell, A., Lalloo, F., Buchan, I.E. and Evans, D.G., 2014. Can multiple SNP testing in BRCA2 and BRCA1 female carriers be used to improve risk prediction models in conjunction with clinical assessment?. BMC medical informatics and decision making, 14(1), p.87.
থাউজ্যান্ড জিনোম প্রজেক্টের বেশ কয়েকটা গবেষণাপত্র আছে, এটা দেখতে পারেন- 1000 Genomes Project Consortium, 2015. A global reference for human genetic variation. Nature, 526(7571), pp.68-74.
Writer: Hassan uz Zaman Shamol
Tags:
Biology