গত পর্ব থেকে আমরা একটু অস্বস্তিকর একটা ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছি- সেটা হচ্ছে বিজ্ঞান জগতের বিভিন্ন ভুল-ত্রুটি-সীমা বদ্ধতা।
বিজ্ঞান সম্পর্কে জানার গোড়াতে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা রাখা জরুরি। তবে যেমনটা আগের পর্বে বলেছি, এই ভুলত্রুটিগুলো আসলে এমন কিছু বড় সমস্যা নয়। কারণ ভেজাল বিজ্ঞান থেকে নির্ভেজাল বিজ্ঞান আলাদা করার সহজ কিছু পদ্ধতি আছে, যেগুলো বিজ্ঞানীরা ভালই জানেন। সেটা নিয়ে সামনে আরো বিস্তারিত কথা আসছে।
কিন্তু আপাতত আমরা অস্বস্তির বিষয়টা নিয়েই আর দু'একদিন কথা বলি। এর কারণ আছে। বিজ্ঞান জগতের সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে আপনি যদি আগে থেকে সচেতন না থাকেন, তাহলে আপনার এই না-জানাটাকে সহজেই অপব্যবহার করা যেতে পারে। আপনার এক বন্ধু এসে আপনাকে বলতে পারে- ব্যাটা তুই বিজ্ঞানীদের এত পাত্তা দিস কেন? জানিসনা ওরা কত দুই নম্বুরি করে?
ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আগে জানা থাকলে আপনি তাকে বলতে পারবেন- এটা কোন বড় সমস্যা নয়। দুই নম্বুরি আর এক নম্বুরি বিজ্ঞান ফারাক করার সিস্টেম আছে।
=============== ==============
বিজ্ঞানের ওপর এখনকার যুগের মানুষের অগাধ ভরসা। বিশেষ করে আমাদের মত মানুষ- যারা বিজ্ঞান গ্রুপের সদস্য- তাদের মধ্যে বিজ্ঞান সম্পর্কে একটা অন্যরকম ভালবাসা কাজ করে।
ভালবাসা আসলে একটু গোলমেলে জিনিস। এর ঠ্যালায় রাতকে দিন মনে হয়। বিজ্ঞানের প্রতি এই ভালবাসার কারণে আমরা অনেকে বিজ্ঞানজগত সম্পর্কে এমন কিছু ধারণা রাখি, যা নিতান্তই অবাস্তব। আমরা অনেকে মনে করি বিজ্ঞানীরা সাধারণ মানুষ নন। তারা বস্তুজগতের অনেক উর্ধ্বে। মর্ত্যের কামনা-বাসনা-ভুল ত্রুটি তাদের মধ্যে কাজ করে না। তাদের লেখা গবেষণাপত্রে যা কিছু আসে সবই বেদবাক্য।
কিন্তু এসব ধারণার একটাও ঠিক নয়।
বিজ্ঞান কোন গায়েবি জিনিস নয়। বিজ্ঞানীরা আপনার-আমার মতই মানুষ। আমাদের যেমন পেটের দায়ে চাকরি করতে হয়, তারাও তাদের চাকরির অংশ হিসেবেই গবেষণা করেন। চাকরিতে ভাল করলে আপনার পদোন্নতি, যশ-খ্যাতি ইত্যাদির সম্ভাবনা দেখা যায়, বিজ্ঞানীদের ক্ষেত্রে তেমনটাই হয়। কাজেই আমাদের মাটির জগতে পয়সাপাতি নামডাক ইত্যাদিকেন্দ্রি ক যেরকম দুর্নীতি-অপরাজন ীতি থাকে, বিজ্ঞান জগতে সেটা নেই এমন ভাবার বিন্দুমাত্র কারণ নেই।
বিজ্ঞানজগতে দুর্নীতির বেশ ক'টা ক্ষেত্র আছে- গবেষণার টাকা বা অনুদান, অর্থের বিনিময়ে জার্নালে প্রবন্ধ ছাপা (যাদেরকে প্রেডেটরি বা শিকারী জার্নাল বলা হয়), বৈষয়িক লাভের জন্য গবেষণার উপাত্ত নিয়ে এদিক-সেদিক করা- মানে যেখানে টাকাপয়সার গন্ধ সেখানেই দুর্নীতির সম্ভাবনা। বাস্তবতা হল- বিজ্ঞান খুবই ব্যয়বহুল একটা ব্যাপার, এখানে আসলেই টাকাপয়সার অনেক ক্ষমতা।
যেমন গত দু'পর্বে আমরা যে গবেষণা প্রবন্ধগুলোর কথা বলছিলাম তাদের কথাই ধরুন। একজন বিজ্ঞানীর জীবনের মূল সম্পদ হচ্ছে তার এই প্রবন্ধগুলো। খুব সহজ করে বললে, কোন বিজ্ঞানী যত বেশি ভাল ভাল গবেষণা করে প্রবন্ধ লিখতে পারেন, বিজ্ঞানসমাজে তার মূল্যায়ন তত বেশি। মূল্যায়ন কথাটার বাংলা অর্থ হল পদোন্নতি, খ্যাতি, বেতন, অন্যান্য সুযোগ সুবিধা।
কথাটা এবার ঘুরিয়ে চিন্তা করুন। কোন বিজ্ঞানী গবেষণা প্রবন্ধ বের করতে না পারলে সমস্যায় পড়েন। ভাল গবেষণা নেই মানে পদোন্নতি নেই, সম্মান নেই, এক পর্যায়ে চাকরি নিয়ে টানাটানি।
এসব শুনে হয়ত আপনাদের মনে হতে পারে- তাহলে তো হলই। ভাল গবেষণা করলেই তো এসব ঝামেলা চুকে যায়।
এখানেই আসল সমস্যা। ভাল গবেষণা সবসময় আপনার-আমার হাতে থাকে না। এটা হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে কোন বিজ্ঞানী মাসের পর মাস পরিশ্রম করেও তার এক্সপেরিমেন্ট দাঁড় করাতে পারছেন না। বিজ্ঞানে আমরা এমন অনেক জটিল সিস্টেম নিয়ে কাজ করি, যেখানে হাজার চিন্তার পরেও অনেক সময় কোথায় কেন ভুল হচ্ছে, এক্সপেরিমেন্ট কেন কাজ করছে না- সেটা ধরা মুশকিল হয়। আবার যদি এক্সপেরিমেন্ট কাজ করেও, এমন হতেই পারে যে কয়েক বছর গবেষণার পর যে ফলাফলটা আসল, সেটা নিতান্তই ম্যান্দামারা।
ব্যবসায় ঝুঁকির কথা শুনেছেন তো? সেরকম ঝুঁকি বিজ্ঞানেও আছে। বিজ্ঞানীরা ব্যর্থতা আর লোকসানের সম্ভাবনা মাথায় রেখেই গবেষণায় হাত দেন।
ধরুন আপনি বাংলাদেশে কলেরার প্রকোপ নিয়ে কাজ করছেন। বইপত্র পড়ে আপনার মনে হল- কলেরা অসুখটা ছড়ানোর সাথে পানির তাপমাত্রার একটা সম্পর্ক আছে। বাস্তববুদ্ধিতে বলে, গরমের দিন যখন পুকুর-নদীর পানিতে রোদ এসে পড়ে, তখন পুকুরের গাছপালায় সালোকসংশ্লেষণ হয়, সেই গাছপালা খেয়ে কলেরার জীবাণু মোটাতাজা হয়ে ওঠে। এভাবে যদি তাপমাত্রার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট করে বলে দেওয়া যায় বছরে কোন সময়টা কলেরা আঘাত হানবে- তাহলে সেটা একটা বিশাল ব্যাপার হবে। মানুষকে আগে থেকেই সতর্ক করে দেওয়া যাবে।
এই বুদ্ধি পকেটে করে আপনি মাঠে গেলেন। এক বছর ধরে পুকুরের পানির নমুনা সংগ্রহ করে তাপমাত্রা, কলেরা জীবাণুর পরিমাণ, ইত্যাদি আরো হাজারটা ব্যাপার নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করলেন। কিন্তু করার পর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেল, তাপমাত্রার সাথে কলেরার প্রকোপের আদৌ কোন সম্পর্ক নেই। এত খাটনি শেষে কলেরার সাথে আবহাওয়ার সম্পর্ক নিয়ে তাই আপনি নতুন করে কিছুই বলতে পারলেন না।
অনেকে হয়ত বলবেন, সম্পর্ক যে নেই সেটা জানাও গুরুত্বপূর্ণ। তা ঠিক, কিন্তু এই উপসংহারটার মধ্যে সেরকম নতুনত্ব নেই। বিজ্ঞানের জার্নাল বা সাময়িকীগুলো এমন গবেষণাকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়, যার মাধ্যমে আমরা প্রকৃতি থেকে নতুন কিছু জানতে পারি। বিজ্ঞানের কনফারেন্সগুলোতে কারো গবেষণার আলোচনা শোনার পর মানুষের প্রথম আপত্তি থাকে- এসব তো আমরা আগেই জানতাম, তোমার কাজে নতুন ব্যাপারটা কী হে?
আপনি হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করে শেষটায় যদি দেখেন এক্সপেরিমেন্ট ব্যর্থ, অথবা যা ফলাফল পেয়েছেন তা জেনে মানুষের এমন কিছু লাভ হবে না- তাহলে আপনার পরিশ্রমের প্রতি জার্নালগুলো আলাদা কোন সিমপ্যাথি দেখাবে না। শেষ পর্যন্ত সেই গবেষণা যে একেবারে বৃথা যাবে তা নয়, কেউ না কেউ হয়ত ছাপাবে, কিন্তু অত বড়ো জার্নাল হয়ত পাত্তা দেবে না।
এর ফলে যা হওয়ার তাই হবে- আপনার সেরকম পদোন্নতি হবে না, আপনার নাম-ডাক বিশেষ শোনা যাবে না, কাজেই বড় বড় জায়গায় চাকরির সম্ভাবনা কমে আসবে।
এই ব্যাপারটা নিয়ে লিখতে গিয়ে একজন ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী বলেছেন- পরিস্থিতি হল publish or be damned। বিজ্ঞানী হয়েছ? ভাল, এবার ভাল ভাল গবেষণাপত্র বের কর, না করতে পারলে গোল্লায় যাও।
গবেষণার সাফল্য জিনিসটা অমূল্য নয় মোটেই। এর বাঁধা বাজারমূল্য আছে।
আপনারা কি একটু আঁচ করতে পারছেন- কেন এরকম পরিস্থিতিতে একজন বিজ্ঞানী তার গবেষণা নিয়ে দু'নম্বুরি করতে চাইতে পারেন? এতকিছুর চাপে ঐ বিজ্ঞানী তার উপাত্ত একটু এদিক সেদিক করে কলেরার সাথে তাপমাত্রার সম্পর্ক গোঁজামিল দিয়ে মিলিয়ে দিতে পারেন- এটা ভাবা কি খুব অস্বাভাবিক?
রিট্র্যাকশানওয়া চ- যার কথা গত পর্বে বলেছিলাম- সেখানকার তালিকায় প্রায় তেইশহাজার চারশ' প্রবন্ধ কী করে গেল?
এই পর্যায়ে কেউ বলতে পারেন- কিন্তু দু'নম্বুরি করে পার পাওয়া তো অত সহজ নয়। জার্নালে তো আর যা-তা জিনিস পাবলিশ হয় না। রক্ষাপ্রহরীর মত পিয়ার রিভিউ বলে একটা ব্যাপার থাকে।
পিয়ার রিভিউ আসলেই দুর্নীতি রোধে অনেকটাই কাজের, কিন্তু ব্যাপারটা একদম নিশ্ছিদ্র নয়। এটা নিয়ে সামনের পর্বে বিস্তারিত। তারপর আমরা দেখব ভেজাল থেকে নির্ভেজাল বিজ্ঞান আলাদা করার উপায়।
Writer: Hassan uz Zaman Shamol
Tags:
Science