বিজ্ঞান সম্পর্কে জানার উপায় - পর্ব ৪


(আপনাদের অনুরোধ করব, আগের পর্বগুলো- অন্তত পর্ব তিন- পড়া শেষ করে তবেই এই পর্বটা পড়তে আসুন। সিরিজটা কী নিয়ে সেটা না বুঝে মাঝখান দিয়ে এই একটা লেখা পড়লে খামোখা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে)
============================
আগের পর্বে আমরা কথা বলছিলাম বৈজ্ঞানিক গবেষণার জগতে কিছু দু'নম্বুরি নিয়ে। বিজ্ঞানীরা সাধারণ মানুষ- অনেক পরিশ্রমী আর বুদ্ধিমান, তবুও মাটির মানুষই। তাদের ভুল হতে পারে, এবং আমাদের মত অর্থ কিংবা যশ-খ্যাতির লোভে তারা গবেষণায় দুর্নীতিও করতে পারেন। অসম্ভব নয়।
এই প্রেক্ষিতে আপনি বলতে পারেন- একটা মিনিট দাঁড়ান। বিজ্ঞানীরা দু'নম্বুরি গবেষণা করল মানলাম, কিন্তু তারা সেটা জার্নাল মোতাবেক জমা দিলেই কি কর্তৃপক্ষ সেটা লুফে নেবে? পিয়ার রিভিউ বলে একটা ব্যাপার আছে না?
আজকের আলোচনা এই পিয়ার রিভিউ নিয়েই।
প্রথম পর্বে আমরা এটা নিয়ে একটু কথা বলেছিলাম- ভুলে গেলে আরেকবার সংক্ষেপে মনে করিয়ে দেই। প্রত্যেক জার্নাল বা বিজ্ঞান সাময়িকীর দরজায় প্রহরীর মত কিছু বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীদের মোতায়েন করা থাকে। এদের কাজ হচ্ছে জার্নাল মারফত যত প্রবন্ধ জমা হয়, সবক'টার চুলচেরা বিশ্লেষণ করা। বিশ্লেষণ করে দেখা প্রবন্ধের কোথাও কোন ভুলভ্রান্তি আছে কিনা, তথ্য-উপাত্ত সন্দেহজনক মনে হয় কিনা, প্রবন্ধের লেখক যা দাবি করছেন আসলেই তথ্য সেদিকে ইঙ্গিত করে কিনা। এই রিভিউয়াররা প্রবন্ধ নিয়ে সন্তুষ্ট হলে তবেই সেটা জার্নালে প্রকাশিত হয়।
এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে গবেষণাপ্রবন্ধে দু'নম্বুরি রোধে পিয়ার রিভিউ জিনিসটার আসলেই একটা বড় ভূমিকা আছে। এটার একটা হাতেকলমে প্রমাণ আপনাদেরকে দেই।

পিয়ার রিভিউয়ের গুরুত্ব


করোনাভাইরাস আসার পর বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখির জগতে একটা পরিবর্তন এসেছে। পিয়ার রিভিউ প্রক্রিয়াটা জরুরি, কিন্তু এটা বেশ সময়সাপেক্ষ। প্রথমে প্রবন্ধ রিভিউয়ার বরাবর পাঠাতে হয়, তারপর তাদের সেটা লাইন বাই লাইন পড়ে দেখার সময় দিতে হয়, লেখক আর রিভিউয়ারদের মধ্যে চিঠি চালাচালি চলে- যথেষ্ট হ্যাপার ব্যাপার। কিন্তু করোনাভাইরাস মৌসুমে আসলে আমাদের হাতে সময় খুবই কম। আমরা এই ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের বক্তব্য যত দ্রুত সম্ভব জানতে চাই। বিশেষ করে ভাইরাসটার বিরুদ্ধে কোন ওষুধপত্র পাওয়া গেল কিনা, এ ধরণের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে আজকের গবেষণা আমরা আজকেই পড়তে চাই। হয়ত এর ওষুধ একদিন পরে বানাতে শুরু করলে একলাখ মানুষ বেশি মারা যাবে।
অথচ তা তো হওয়ার নয়। ওপরে যেমনটা বললাম, পিয়ার রিভিউয়ের গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় এরকম ঝড়ের বেগে জার্নালে প্রবন্ধ আসা অসম্ভব।
এই ঝামেলাটা এড়াতে বিজ্ঞানীরা একটা মজার কাজ করলেন। তারা তাদের গবেষণা প্রবন্ধগুলো জার্নাল বরাবর পাঠালেন ঠিকই, কিন্তু একই সাথে গবেষণার পাণ্ডুলিপিটা ফট করে ইন্টারনেটে আপলোড দিয়ে দিলেন। এই প্রক্রিয়ায় কোন রিভিউ-টিভিউয়ের বালাই নেই- ফেসবুকে যেমন মানুষ পোস্ট দেয়, তারা অনেকটা বিজ্ঞানের জন্য ফেসবুক বানিয়ে সেখানে তাদের গবেষণা "পোস্ট" করা শুরু করলেন।
এর ফলে সুবিধে হল বটে- বিজ্ঞানীরা (এবং আমরা সাধারণ মানুষও) খুব দ্রুত অন্য বিজ্ঞানীদের গবেষণা চেখে দেখার সুযোগ পেয়ে গেলেন। সেই কবে এটা রিভিউ হয়ে জার্নালে আসবে, অতদিন অপেক্ষা করার আর প্রয়োজন রইল না। বিশেষ করে করোনাভাইরাস মৌসুমে ব্যাপারটার আসলেই প্রয়োজন ছিল।
এই প্রক্রিয়ার কারণে বিগত মাসকয়েক ধরে আমরা মোটামুটি দু'ধরণের বিজ্ঞান দেখছি- এক হচ্ছে পিয়ার রিভিউ হয়ে জার্নালে আসা বিজ্ঞান, আরেক হচ্ছে পিয়ার রিভিউ হওয়ার আগে ওয়েবসাইটে জমা পড়া বিজ্ঞান। এই ভাগটা আমাদেরকে বিজ্ঞানে পিয়ার রিভিউয়ের গুরুত্ব খুব চমৎকারভাবে বুঝিয়ে দিল। বলছি কীভাবে।
এই সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে আপনাদেরকে রিট্র্যাকশানওয়াচ বলে একটা ওয়েবসাইটের কথা বলেছিলাম। তাদেরকে বিজ্ঞান জগতের গোয়েন্দা সংস্থা ভাবতে পারেন। তাদের কাজ হল- যত জায়গা থেকে যত গবেষণাপ্রবন্ধ বড়সড় ভুল থাকার কারণে ফিরিয়ে নেওয়া হয়, তার একটা বিশদ তালিকা বানিয়ে রাখা। এদের হিসেবমতে, নতুন করোনাভাইরাসটা আসার পর মোট পনেরোটা গবেষণাপ্রবন্ধ এরকম ভুল থাকার কারণে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই তালিকাটা যদি দেখেন- লিঙ্ক কমেন্টে দিলাম- দেখবেন পনেরোটার মধ্যে সাতটাই আসলে দ্বিতীয় শ্রেণীর বিজ্ঞান। অর্থাৎ এদেরকে পিয়ার রিভিউয়ের জন্য দেওয়া হয়নি- সেই বিজ্ঞান ওয়েবসাইটগুলোতে ঝাড়াইবাছাই ছাড়াই পোস্ট করা হয়েছিল। পিয়ার রিভিউ না থাকার কারণেই এই গোলমেলে বিজ্ঞানঅলা প্রবন্ধগুলো মাঝখান দিয়ে এত জনপ্রিয়তা পেল।
এই ছোট্ট এক্সপেরিমেন্টটা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, বিজ্ঞান জগতে যত আবর্জনা আসে, তার অর্ধেকই আসলে পিয়ার রিভিউয়ের জন্য আলোর দেখা পায় না। করোনাভাইরাস এসেছিল বলে এদের অনেকগুলো সেই "ওয়েবসাইট সিস্টেমে" আলোর মুখ দেখেছিল। কিন্তু কড়াকড়ি রিভিউ প্রক্রিয়া জারি থাকলে সেটা হওয়ার ওরকম জো ছিল না।
বিজ্ঞানের জগতে তাই পিয়ার রিভিউয়ের ভূমিকা অবশ্যই আছে। কোন সন্দেহ নেই।
কিন্তু এই প্রক্রিয়াটা নিশ্ছিদ্র নয়। এরও ফাঁকফোকর আছে, এবং সেই ফাঁকফোকর গলে মাঝেমধ্যেই গবেষণাপত্রে তথ্যগত ভুল চলে আসতে পারে। গত পর্বে দুর্নীতি নিয়ে অনেক কিছু বলেছি, আজ সেটাকে পাশে রেখে শুধু প্রক্রিয়াটার সীমাবদ্ধতা নিয়ে বলি। আগে আমাদের বুঝতে হবে- পিয়ার রিভিউয়ারদের ক্ষমতা কতটুকু। তারা কী করেন, এবং চেষ্টা করলেও কী করতে পারেন না।

রিভিউয়াররা যা পারেন


যেমন, যদি আপনার গবেষণা প্রবন্ধে যুক্তিগত কোন ভুল থাকে, সেটা রিভিউয়ার খেয়াল করবেন। ধরুন আপনি লক্ষ্য করলেন- বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আক্রান্তদের মধ্যে অদ্ভুত কিছু উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। কেন যেন এই রোগীদের মধ্যে ডায়রিয়ার হার বেশি। ব্যাপারটা নিয়ে তাড়াতাড়ি একটা প্রবন্ধ লিখে আপনি জার্নাল বরাবর জমা দিলেন
কিন্তু আপনার প্রবন্ধ যখন পিয়ার রিভিউয়ারের হাতে পৌঁছল, তখন ভদ্রলোকের ভ্রূ খানিকটা কুঁচকে উঠল। এর কারণ, প্রবন্ধের এক জায়গায় আপনি লিখেছেন- যেহেতু বাংলাদেশের করোনা আক্রান্তদের মধ্যে ডায়রিয়ার হার বেশি, তার মানে নিশ্চয়ই বাংলাদেশে ভাইরাসটা বিবর্তন হয়ে আরো ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। সে শ্বাসযন্ত্রের অসুখ বাঁধানোর সাথে সাথে পেটের অসুখও করছে।
এই কথাটাতে একটা বড়সড় যৌক্তিক ভুল আছে। করোনা রোগীদের ডায়রিয়া বেশি হচ্ছে মানেই যে ভাইরাসটার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে, এমনটা মনে করার কারণ নেই। এর কারণ হুবহু একই ভাইরাস স্থান-কাল-পাত্রভেদে পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে ভিন্নরকম অসুখ বাঁধাতে পারে। যেমন- যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন, তাদের শরীরের রোগ প্রতিরক্ষার হার এমনিতেই কমে যায়। সে অবস্থায় তাদের শরীরে অন্যান্য রোগজীবাণু বাসা বাঁধার সুযোগ পায়। বাংলাদেশ যেহেতু আগে থেকেই পানিবাহিত রোগ বেশি ছড়ায়, কাজেই এই দেশে করোনা রোগীদের মধ্যে ডায়রিয়া বেশি হচ্ছে। রহস্যটার এত সহজ সমাধান থাকতে সেটাকে তোয়াক্কা না করে আপনি গিয়েছেন ভাইরাস পরিবর্তনের তত্ত্বে- যেটা কিনা পৃথিবীর অন্য কোথাও ওভাবে দেখা যায়নি।
এরকম যুক্তি দিলে সেটা পিয়ার রিভিউয়ারের পছন্দ হবে না- উনি প্রবন্ধের এসব জায়গায় লাল কালি দিয়ে আপনার ফিরতি চিঠি পাঠাবেন। অর্থাৎ গবেষণাপত্রে আপনি যেভাবে যুক্তির সিঁড়িটা সাজাচ্ছেন, সেখানে কোন ভুল হচ্ছে কিনা সেটা রিভিউয়াররা ধরতে পারেন, এবং অধিকাংশ সময় তারা সেটা বেশ ওস্তাদির সাথেই করেন। এটুকুর মধ্যে রিভিউ প্রক্রিয়া সফল।

রিভিউয়াররা যা পারেন না


কিন্তু যে ব্যাপারটা পিয়ার রিভিউরা করতে পারেন না- যেটা তাদের পক্ষে করা সম্ভব না- সেটা হচ্ছে আপনার তথ্যে কোন ভুল আছে কিনা সেটা বের করা। হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে খুব অদ্ভুত চেহারার তথ্য-উপাত্ত এলে সে ব্যাপারে রিভিউয়াররা সন্দেহ পোষণ করতে পারেন। কিন্তু মোটামুটি যদি বাস্তবসম্মত তথ্য থাকে, তাহলে সেখানে ভুল বা দু'নম্বুরী হয়েছে কিনা সেটা ধরার উপায় পিয়ার রিভিউয়ারদের নেই। তারা আপনার এক্সপেরিমেন্টটা যে দ্বিতীয় আরেকবার করে দেখবেন, তার কোন সুযোগ নেই।
গত পর্বের ঐ কলেরার উদাহরণটাতে ফিরে যাই। ধরুন বছরখানেক ধরে আমি পুকুর থেকে পানির নমুনা এনে কলেরার জীবাণু তাতে আছে কি নেই, এ নিয়ে পরীক্ষা করে চলেছি। যদি এই বিষয়ে প্রবন্ধের পিয়ার রিভিউয়াররা নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করতে চানও, সেটা আর সম্ভব না। কারণ এসব নমুনা পরীক্ষা করার পর পর ফেলে দিতে হয়- কয়েকদিন রেখে দিলেই এদের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হয়ে যায়। তারপর রাখা না রাখা একই কথা। কাজেই এসব নমুনা পরীক্ষার ফলাফল আমি আমার ল্যাব খাতায় যা টুকে রাখছি, সেটা ছাড়া আমার তথ্য-উপাত্তের দ্বিতীয় কোন দলিল-প্রমাণ নেই। আমার কথাই এখানে শেষ। আমি যদি দু'নম্বুরি তথ্য বুদ্ধিমানের মত সাজিয়ে যদি একটা প্রবন্ধ জমা দেই- রিভিউয়ারের বাপের সাধ্যি নেই সে আমাকে ধরবে। আর যদি নমুনা থাকেও, আমার পুরো এক্সপেরিমেন্ট বছরের পর বছর লাগিয়ে টাকাপয়সা জলাঞ্জলি দিয়ে দ্বিতীয়বার করে দেখা রিভিউয়ারের কাজের মধ্যে পড়ে না।
এখানে একটা গবেষক বা তার প্রতিষ্ঠানের সততার ওপর বিশ্বাস রাখার একটা ব্যাপার আছে। এজন্যই বললাম, পিয়ার রিভিউ প্রক্রিয়া কার্যকরী বটে, কিন্তু নিশ্ছিদ্র বা সব সমস্যার জবাব নয়।

সমাধান?


গত তিন পর্ব ধরে আমরা যেসব সমস্যার কথা বলছি, এগুলো সাধারণ মানুষের কানে একটু অন্যরকম লাগতে পারে, কিন্তু আসলে বিজ্ঞানীরা এই সবকিছু সম্পর্কেই সচেতন। তারা তাদের ফিল্ডে দুর্নীতির সম্ভাবনা, পরিণতি, ইত্যাদি সম্পর্কে ভালই খোঁজ রাখেন। তাহলে তারা কীভাবে ভেজাল থেকে নির্ভেজাল বিজ্ঞানকে আলাদা করেন?
এটা নিয়েই থাকবে আমাদের আগামী পর্বের আলোচনা- কীভাবে বিজ্ঞানীরা এত ঝামেলার মধ্যেও ঠিকঠিকই বুঝে নেন, কোন বিজ্ঞানটুকু ক্লিয়ার আর কোনটুকুতে ভেজাল আছে।
===================

Writer: Hassan uz Zaman Shamol

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম