আগুনের রহস্য (পর্ব ২)


দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি যে, তাপ উৎপন্ন হওয়ার জন্য আগুন জ্বলা অত্যাবশ্যক। অর্থাৎ আগুন ছাড়া উষ্ণতা অসম্ভব। কোন কিছু না পোড়ালে উত্তাপ নির্গত হয় না। কনকনে ঠাণ্ডা সহ্য করতে না পেরে শীতের সকালে গ্রাম কিংবা শহরের সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা আজও খড়কুটো জ্বালিয়ে তৈরি আগুনের উষ্ণতায় গা গরম করে থাকেন। শুধু যে সুবিধাবঞ্চিতরাই এরকম করে তা নয়, আমাদের মতো কিছু শৌখিন ‘মোষ-তাড়ুয়াও’ রিপুর তাড়নায় মাঝে মধ্যে এই কাজ করে থাকে। পার্থক্য একটাই- ওরা করতে বাধ্য হয়, আর আমরা করি শখের বশে। তবে আর যাই বলুন, অন্তত শৌখিনদের জন্যে হলেও অভিজ্ঞতাটা কিন্তু দারুণ! তাপ পোহাতে পোহাতেই উনবিংশ শতাব্দীতে তাপগতিবিদ্যা নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করলেন যে, পদার্থের অণুগুলো কখনই স্থির থাকে না। তাই আপাতদৃষ্টিতে নিরুত্তাপ ও নিস্তেজ মনে হলেও সকল পদার্থ থেকেই অল্প পরিমাণে তাপীয় বিকিরণ নির্গত হয়। কারণ কোন পদার্থই আদতে ‘একেবারে ঠাণ্ডা’ নয়। ১৮৪৮ সালে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ লর্ড কেলভিন পদার্থের তাপগতীয় তাপমাত্রা (thermodynamic temperature) পরিমাপের জন্য একটি পরম স্কেলের প্রস্তাবনা করেন। যে স্কেলে তাপমাত্রা গণনা শুরু হবে একেবারে শূন্য থেকে। যেহেতু সকল পদার্থেরই অণুগুলোর গতির ফলে সৃষ্ট অন্তর্নিহিত তাপগতীয় শক্তি থাকে, তাই সবারই একটি অন্তর্নিহিত তাপমাত্রা থাকবে। এই তাপমাত্রা কখনই শূন্য হবে না। কেলভিন প্রদত্ত এই স্কেলকেই তাপমাত্রার পরম স্কেল (absolute scale) বা তাপগতীয় স্কেল (thermodynamic scale) বলা হয়। সেলসিয়াস স্কেলের -২৭৩.১৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা কেলভিন স্কেলে পরম শূন্যের সমান। কেলভিনে তাপমাত্রা প্রকাশের সময় ‘ডিগ্রী’ শব্দ ব্যবহার করা হয় না। বিশদ উপযোগীতার কারণে কেলভিন স্কেলকে তাপমাত্রা পরিমাপের আন্তর্জাতিক স্কেল হিসেবে গ্রহন করা হয়েছে। চার্লস, বয়েল প্রমুখ বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন গ্যাস নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখেন যে, যেকোন গ্যাসের ক্ষেত্রে এর পরম তাপমাত্রা ঐ গ্যাসের আয়তনের সমানুপাতিক এবং চাপের ব্যস্তানুপাতিক হারে পরিবর্তিত হয়। এ থেকে বুঝা যায় যে, কোন পদার্থকে ঠাণ্ডা করতে করতে কখনই কেলভিন স্কেলের সেই পরম শূন্য (abosolute zero) তাপমাত্রায় আনা যাবে না। কারণ, তখন সেই বস্তুর আয়তন শূন্য হয়ে যাবে, যা আদতে অসম্ভব। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব যেমন আলোর গতি অর্জন করাকে হারাম ঘোষণা করেছে, ঠিক তেমনি লর্ড কেলভিনের সেই পরম শূন্য তাপমাত্রাও আমাদের হাত পা বেধে দিয়েছে। এ যেন এক অনতিক্রম্য দেয়াল, প্রকৃতি চায় না আমরা কখনো পরম শূন্যতায় পৌঁছাই! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কেলভিন মশাইয়ের আসল নাম কিন্তু লর্ড কেলভিন নয়! তার আসল নাম উইলিয়াম থমসন। ‘লর্ড কেলভিন’ তার লাটসাহেবী উপাধি।
সময় এবং বিজ্ঞান কারো জন্য অপেক্ষা করে না। কেলভিনের পরম শূন্য তাপমাত্রা একটা পথের ইতি টানলেও কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন থেকেই যায়। আবার বিজ্ঞানীরাও নাছোড়বান্দা। তাই তাপমাত্রার এই পরম স্কেল আরেকটি গভীর প্রশ্নের দিকে বিজ্ঞানীদের ঠেলে দেয়। এই ঘটনাটা ঘটে মূলত উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিককার মধ্যবর্তী সময়ে। পরম শূন্য তাপমাত্রায় পৌঁছানো যেহেতু অসম্ভব তাই এমন বস্তুর অস্তিত্ব অসম্ভব যার তাপমাত্রা পরম শূন্য। আপাতদৃষ্টিতে নিরুত্তাপ ও সমাহিত মনে হলেও পরম শূন্য তাপমাত্রার চেয়ে যৎসামান্য বেশী তাপমাত্রায় অবস্থানরত সকল জাগতিক বস্তুই তাপীয় বিকিরণ ঘটায়। এই বিকিরণ বস্তুর পরম তাপমাত্রার সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায়। পূর্ববর্তী বিজ্ঞানীদের তাত্ত্বিক ও পরীক্ষামূলক কাজ এবং লাটসাহেবের পরম স্কেলের ধারণাকে পূঁজি করে, ১৮৬০ সালে পদার্থবিদ গুস্তাভ কির্শফ (Gustav Kircchoff) তাপীয় বিকিরণ ব্যাখ্যা করার জন্য কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ (black-body radiation) নামে তাপগতিবিদ্যায় একটি নতুন ধারণার জন্ম দেন। কির্শফ ঠিক কেলভিনের পরম শূন্য তাপমাত্রার মতোই একটি তাত্ত্বিকভাবে নিখুঁত কালো রঙয়ের অসচ্ছ বস্তু কল্পনা করেন যা পরিপার্শ্বের সাথে তাপগতীয় সাম্যাবস্থায় থাকাকালে এর পৃষ্ঠে আপতিত সকল রঙয়ের আলো শোষণ করে নেয় এবং কোন আলোই প্রতিফলন করে না। তার মতে এধরণের কৃষ্ণ বস্তু থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তাপীয় বিকিরণ নির্গত হয়। এই বিকিরণের তীব্রতা কৃষ্ণবস্তুর পরম তাপমাত্রার সমানুপাতিক। পরমশূন্য তাপমাত্রার মতোই বাস্তবে এরকম আদর্শ অপ্রতিফলক (non-reflective) কালো বস্তু পাওয়া যায় না। কারণ সকল বস্তুই কমবেশী আলো প্রতিফলন করে। তবুও গাণিতিক হিসাব নিকাশের সুবিধার্থে আমাদের দেশের তথাকথিত 'ক্রমবর্ধমান জাতীয় উন্নয়ের' মতোই এরকম আদর্শ একটি বস্তু (ideal physical body) কল্পনা করে নেয়া হয়। কির্শফ খুব ভালো একটা কাজ করেছিলেন। তার কাজের প্রভাব ঠিক কতটা সুদূরপ্রসারী হবে তা হয়ত তিনি নিজেও উপলব্ধি করতে পারেন নি। কির্শফের কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল ডেমোক্রিটাসের ‘অবিভাজ্য কণার’ আরো গভীরে, কোয়ান্টাম জগতের রহস্যপূরীতে প্রবেশের চাবিকাঠি!

কৃষ্ণবস্তু বিকিরণ নিয়ে জল ঘোলা করতে গিয়ে লুডভিগ বলজম্যান (Ludwig Boltzmann) ও জোসেফ স্টেফান (Joseph Stefan) নামে দুজন অস্ট্রীয় পদার্থবিদ সম্মিলিতভাবে পদার্থের অণুগুলোর গতিশীলতা, গতির ফলে উৎপন্ন তাপশক্তি ও নির্গত তাপীয় বিকিরণের মধ্যে একটি পরিসংখ্যান নির্ভর গাণিতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে সচেষ্ট হন। তাদের এই গাণিতিক বিধি স্টেফান-বলজম্যান সূত্র নামে পরিচিত। সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিল, কিন্তু বাগড়া বাধালেন লর্ড রেলে (Lord Rayleigh) ও স্যার জেমস জিন্স (Sir James Jeans) নামে দুজন ইংরেজ পদার্থবিদ। তারা লক্ষ্য করলেন, আদর্শ কৃষ্ণবস্তু থেকে নির্গত তাপীয় বিকিরণের কম্পাঙ্ক অতিবেগুনি সীমা অতিক্রম করার পর বিকিরণ শক্তির পরিমাণ অসীম হয়ে যায়। যা কার্যত শক্তির নিত্যতা সূত্রের লঙ্ঘন। অতএব, পর্যবেক্ষণের সাথে কৃষ্ণবস্তু বিকিরণের প্রচলিত মডেল অসঙ্গতিপূর্ণ। বিজ্ঞানের ইতিহাসে রেলে-জিন্সের এই প্রস্তাবনা অতিবেগুনি বিপর্যয় (Ultraviolet catastrophe) নামে পরিচিত।

এই সমস্যার একটি উচ্চাভিলাষী সমাধান নিয়ে স্বপ্নের জাদুকরের মতোই রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হন কোয়ান্টাম তত্ত্বের জনক, জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক (Max Plank)। ১৯০০ সালে প্ল্যাঙ্ক একটি যুগান্তকারী প্রস্তাবনা করেন। তিনি বলেন যে, কৃষ্ণবস্তু থেকে তাপীয় বিকিরণ নিরবচ্ছিন্নভাবে নির্গত না হয়ে, নির্দিষ্ট শক্তি সম্পন্ন ‘শক্তির প্যাকেট’ আকারে নির্গত হয়। তিনি এই প্যাকেটগুলোর নাম দেন ‘কোয়ান্টা’ (quanta)। আমরা যদি কোয়ান্টাকে নদীর স্রোত ও বালুর ট্রাক(!) হিসেবে কল্পনা করি, তাহলে বলা যায়, বিকীর্ণ শক্তি নদীর স্রোতের মতো ধারাবাহিকভাবে প্রবাহিত না হয়ে, ট্রাকে করে বালু বহনের মতো বিছিন্নভাবে প্রবাহিত হয়। এই ট্রাকগুলো আবার বালি (শক্তি) দিয়ে সম্পূর্ণ ভরাট হওয়ার আগ পর্যন্ত যাত্রা শুরু করে না। তাই ভগ্নাংশ কিংবা অর্ধেক খালি কোয়ান্টা শক্তি বহন করে না। বিকিরণের ক্ষেত্রে এই প্যাকেটগুলোর একটি অশূন্য সর্বনিম্ন মান থাকে। এর চেয়ে কম শক্তি সম্পন্ন বিকিরণ সম্ভব নয়। শুনতে বৈপ্লবিক মনে হলেও তখনকার দিনের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা প্ল্যাঙ্কের এই গাঁজাখুরি প্রস্তাবনাকে বড়জোর গাণিতিক গুঁজামিল হিসেবে দেখতেই বেশী সন্তুষ্ট ছিলেন। ১৯০৫ সালে তীক্ষ্ণধী আইনস্টাইন প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও বিশেষ আপেক্ষিকতা ব্যবহার করে সফলভাবে আলোক-তড়িৎ ক্রিয়া (photo-electric effect) ব্যাখ্যা করেন। এজন্য ১৯২১ সালে আইনস্টাইন নোবেল পুরস্কার জয় করেন। এরপর রাতারাতি বিজ্ঞানী মহলে কোয়ান্টাম তত্ত্ব ‘অফিসিয়াল স্ট্যাটাস’ পেয়ে যায়। আইনস্টাইন তার গবেষনাপত্রে কোয়ান্টাকে ‘ওয়েভ প্যাকেট’ নামে উল্লেখ করেন। আজকে আমরা জানি, এই ওয়েভ-প্যাকেটগুলো আসলে তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গের কণা ফোটন (photon)। প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে নিলস বোর ১৯১৩ সালে পরমাণুর চিরায়ত (classical) কোয়ান্টাম মডেল প্রস্তাব করেন। এই মডেলে ইলেকট্রনগুলো নির্দিষ্ট শক্তিসম্পন্ন শেলে বিচরণ করতে সক্ষম। শেলগুলো অনেকটা বালুর ট্রাকের মতোই কাজ করে। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুসারে এই ফোটন কণা ইলেক্ট্রনকে উত্তেজিত করে উচ্চশক্তি সম্পন্ন শেলে অধিগমনের জন্য শক্তির যোগান দেয়। নিম্ন শক্তি সম্পন্ন স্থিতিশীল শেলে বা অর্বিটালে ফিরে আসার সময় ঠিক একই পরিমাণ শক্তি ফোটন হিসেবে ইলেকট্রন কর্তৃক নির্গত হয়। প্ল্যাঙ্ক, আইনস্টাইন ও বোর দেখান যে, নির্গত শক্তির পরিমাণ ফোটনের কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক। পরমাণুর কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস থেকে যতই দূরবর্তী শেলে যাওয়া যায়, শক্তির মান ততই বাড়তে থাকে। নিকটতম দুটি শেলের মধ্যে অধিগমন ও প্রত্যাবর্তনের ফলে নির্গত ফোটনের শক্তি ও কম্পাঙ্কের ভাগফল একটি ধ্রুব সংখ্যা। একে প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক (Planck’s constant) বলা হয়। আগের পর্বগুলোতে বোরের প্রস্তাবিত পরমাণু মডেল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তাই এখানে আর অত্যুক্তি করছি না। যাই হোক, নব্য উদ্ভাবিত কোয়ান্টাম তত্ত্বের আলোকে প্ল্যাঙ্ক কৃষ্ণবস্তু বিকিরণের কোয়ান্টাম মডেল প্রস্তাবনা করেন। প্ল্যাঙ্কের প্রস্তাবিত মডেল সফলভাবে কৃষ্ণবস্তুর বর্ণালী ঘনত্ব (spectral density) ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়। এই মডেল পূর্ববর্তী মডেলগুলোর অসঙ্গতি দূর করে ও অতিবেগুনি বিপর্যয়ের অবসান ঘটায়। একইসাথে প্ল্যাঙ্কের তত্ত্ব ব্যবহার করে আলোক-তড়িৎ ক্রিয়া, কম্পটোন প্রভাব ও হাইড্রোজেন পরমাণুর বর্ণালী ব্যাখ্যা করা এবং রিডবার্গ ধ্রুবকের মান নির্ণয় করা সম্ভব হয়। বোরের পরমাণু মডেলের সীমাবদ্ধতার কারনে তা একসময় পরিত্যাক্ত হলেও, প্ল্যাঙ্কের তত্ত্ব এখনো প্রমিত। অতিক্ষুদ্র জগতের সব নিয়মকানুন প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবকের কাঁধে ভর দিয়েই বাবু মেরে বসে আছে। কোথা থেকে কোথায় এসে ঠেকলাম আমরা! ভাবতেও অবাক লাগে, কির্শফের সেই কৃষ্ণবস্তুর ধারণা আধুনিককালে পদার্থবিজ্ঞানীদের সামনে এক অবারিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করে দিলো!

দৃষ্টিগ্রাহ্য ও অদৃশ্যমান সকল তাড়িৎচৌম্বক বিকিরণই আলোর কণা ফোটন কর্তৃক পরিবাহিত হয়। গোলাপ পাপড়ির মনোমুগ্ধকর রঙ, রঙধনুর দৃষ্টিনন্দন বর্ণীল আলোকসজ্জা, কিংবা বিগলিত লাভার বিধ্বংসী উত্তাপ- সবকিছুই এই ফোটনের সুচতুর কারসাজি। কিন্তু এই ফোটনের এক অদ্ভুত দ্বৈত চরিত্র (dual nature) আছে। দু-মুখো সাপের মতো এই ফোটন বাবাজী একইসাথে কণা ও তরঙ্গের ন্যায় আচরণ করে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও ফোটনের ‘দুই নৌকায় পা দিয়ে চলার’ সপক্ষে অসংখ্য প্রমাণ আছে। ১৮০৩ সালে বহুমুখী প্রতিভাধর ব্রিটিশ বিজ্ঞানী থমাস ইয়ং (Thomas Young) তার বিখ্যাত দ্বি-চির পরীক্ষার (dual-slit experiment) মাধ্যমে আলোর ব্যতিচারের (interference) সপক্ষে পরীক্ষামূলক প্রমাণ হাজির করেন। ইয়ং-এর এই পরীক্ষা আলোর তরঙ্গ তত্ত্বের সপক্ষে জোড়ালো প্রচারণা চালানো দুই বিজ্ঞানী হাইগেনস ও ফ্রেনেলের নীতির (Huygens-Fresnel principle) সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। যেহেতু তরঙ্গ ছাড়া ব্যতিচার সম্ভব নয়, সেহেতু ইয়ং এর পরীক্ষার মাধ্যমে ফোটনের তরঙ্গ চরিত্র বিজ্ঞানী মহলে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু, বিজ্ঞানের বাজারে প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বের আমদানি হওয়ার পর দেখা গেল, ফোটন কখনো কখনো কণা আবার কখনো কখনো তরঙ্গের ন্যায় আচরণ করছে। আইনস্টাইন ফোটনের এই কণা চরিত্রকে কাজে লাগিয়েই আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, যা পরে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়। ১৯২৪ সালে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার আরেক দিকপাল, ফরাসি পদার্থবিদ লুইস ভিক্টক ডি-বগ্রলি (Louise Victor De-Broglie) প্রস্তাবনা করেন যে, ফোটনসহ সকল বস্তুই একইসাথে তরঙ্গ ও কণার ন্যায় আচরণ করে। ভরবেগ আছে এমন সকল বস্তুরই নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য থাকবে। একে ডি-ব্রগলির বস্তু তরঙ্গ (matter wave) বলা হয়। এই নিয়ম শুধু ফোটন নয়, সকল জাগতিক বস্তুর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অণুর মতো বৃহদাকার বস্তুও কিঞ্চিৎ তরঙ্গ ধর্ম প্রদর্শন করে। ১৯২৯ সালে ইস্টারম্যান ও স্টার্নের (Estermann-Otto Stern) পরীক্ষায় এটি প্রমাণিত হয়। অতি বৃহৎ গতিশীল বস্তুরো তরঙ্গদৈর্ঘ্য থাকে। কিন্তু তা এতটাই নগণ্য যে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। কিন্তু শুধুমাত্র কোয়ান্টাম পর্যায়ে গেলেই কণাসমূহের এই অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য প্রকট হয়। কোয়ান্টাম সিস্টেমে (quantum mechanical system) রহস্যজনক কারণে সর্বদাই তরঙ্গ–কণা দ্বৈততা (wave-particle duality) বজায় থাকে। পরবর্তীতে শ্রোডিংগার ও হাইজেনবার্গের মতো মহারথীরা দেখান যে, কোয়ান্টাম পর্যায়ে
(অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ক্রিকেট দলের সাথে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন) ইংরেজ বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (James Clerk Maxwell) প্রদত্ত চিরায়ত তাড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্র তত্ত্ব (classical electromagnetic field theory) মোটেও কাজ করে না। তারা কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব (quantum field theory) ও ওয়েভ ফাংশনের (wave function) সাহায্যে কণাসমূহের দ্বৈত চরিত্রের ব্যাখ্যা দেন। আর কিছু না করলেও, হাইজেনবার্গ ও শ্রোডিংগার যথাক্রমে অনিশ্চয়তা নীতি (uncertainty principle) ও ওয়েভ ফাংশন আবিষ্কারের জন্য চিরস্মরনীয় হয়ে থাকতেন। এ নিয়ে হয়ত অন্য আরেকদিন বিস্তারিত আলোচনা করব।
এই ধারাবাহিকের শুরুতে আমরা কিছু সুপ্রাচীন ও মৌলিক প্রশ্ন দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু করেছিলাম। মাঝপথে এসে কিছু কাঠখোট্টা কথা বলে ফেলেছি। কঠিন কঠিন বিদঘুটে শব্দ টাইপ করতে আমার নিজেরো ভালো লাগে না। কি আর করব বলুন? এছাড়া যে উপায় নেই। তবে আপনারা যারা এতদূর পর্যন্ত আমার সাথে থেকে ধৈর্য ধরে আমার লেখা পড়েছেন, তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। পাঠকদের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া লেখকদের লিখতে অনুপ্রেরণা যোগায়। অনেকে ইনবক্সে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তাদেরকেও আমার প্রাণঢালা অভিনন্দন। আমি পাঠকদের কাছে সত্যিই কৃতজ্ঞ! এই কৃতজ্ঞতার দাবী থেকেই আরো কিছুদূর ধৈর্য ধরে আমার সাথে থাকার জন্য অনুরোধ করছি।
এই অনুচ্ছেদ শুরু করতে না করতেই, সহাস্যবদনে বাংলাদেশের জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী মমতাজের একটা গান মনে পরে গেল। ভাবছি গানটাকেই উপমা হিসেবে ব্যবহার করব। গানটি হল-
“নান্টু ঘটকের কথা শুইনা, অল্প বয়সে করলাম বিয়া।
মুরুব্বীরা কইল সবাই নো টেনশন, নো চিন্তা, জীবনে পাইছ তুমি দারুণ একখান পোলা।
পোলা তো নয় যেন আগুনেরি গোলারে, পোলাতো নয় যেন আগুনেরি গোলা!”
ভাবছেন এই গানের সাথে বিষয়বস্তুর সম্পর্ক কি? রসিকতা করছি না মশাই, একটু অপেক্ষা করুন; এই বিদগ্ধ কন্ঠশিল্পীর সুললীত গীতিকার মাঝে নিগূঢ় বিজ্ঞান নিহিত আছে। চিন্তাশীল মানুষ মাত্রই তা উপলব্ধি করতে পারে।
বিজ্ঞানের আগুন যেমন পারমাণবিক বোমার মতো বিধ্বংসী, ঠিক তেমনই সঙ্গীতের মতোই প্রাণবন্ত। তাপ জীবদেহের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের দেহেও প্রতি মুহূর্তে অসংখ্য তাপোৎপাদী বিক্রিয়া ঘটে চলছে। ফলে আমাদের শরীর থেকে প্রতি মুহূর্তে চারিদিকে তাপীয় বিকিরণ নির্গত হচ্ছে। খালি চোখে এই উত্তাপ দেখা যায় না। কিন্তু শরীর স্পর্শ করলে উষ্ণতা হিসেবে অনুভব করা যায়। নাইট ভিশন গগল (Night-vision goggle) কিংবা ইনফ্রারেড ক্যামেরা (Infrared camera) দিয়ে মানবদেহ থেকে নির্গত তাপ দেখা যায়। আমি এই পোস্টে দুটি ছবি সংযুক্ত করেছি। একটি ছবিতে উত্তপ্ত লাভা দেখা যাচ্ছে, যা এতটাই উত্তপ্ত যে কৃষ্ণবস্তু বিকিরণের (Black-body radiation) নিয়মানুসারে দৃশ্যমান বর্ণালীতে তাপীয় বিকিরণ ঘটাচ্ছে। আরেকটি ছবিতে একজন মানুষের শরীর থেকে নির্গত তাপীয় বিকিরণ দেখা যাচ্ছে। এই ছবিটি অবলোহিত আলো দেখতে পায় এমন বিশেষ সংবেদনশীল ক্যামেরা দিয়ে তোলা। দুটি ছবিতেই লাল অঞ্চলগুলো সবচেয়ে বেশী উত্তপ্ত। সুতরাং, শুধু মমতাজের গানের চরিত্র ‘পোলা’ নয়, প্রতিটি মানুষ, এমনকি প্রতিটি প্রাণিই একেকটি জীবন্ত ‘আগুনের গোলা’। কারণ জীবন একটি তাপগতীয় প্রক্রিয়া। আর সকল প্রাণিই এই তাপগতীয় প্রক্রিয়ার বাহক। তাপগতীবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রানুসারে সকল তাপগতীয় ব্যবস্থাই (thermodynamic system) ক্রমশ সুশৃঙ্খল অবস্থা থেকে বিশৃঙ্খলার দিকে অগ্রসর হয়। তেজদৃপ্ত বহ্নিশিখা থেকে ক্রমশ নিস্তেজ শান্ত-সমাহিত অন্ধকারের দিকে ধাবিত হয়। এটা প্রকৃতির এক অলঙ্ঘনীয় নিয়ম। আগের পর্বে একটা কথা বলেছিলাম, আপনাদের মনে আছে কিনা জানিনা- “চলচ্চিত্র কিংবা বাইশ গজের তারকাদের প্রতি যেমন এদেশের মানুষের মনে দুর্দমনীয় আকর্ষণ কাজ করে, ঠিক তেমনি স্থিতি ও সাম্যাবস্থার প্রতি প্রকৃতির মনেও দুর্দমনীয় এক ঝোঁক কাজ করে।” ঠিক এই কারনেই প্রকৃতি ক্রমশ বিশৃঙ্খলার দিকে ধাবিত হয়। কারণ প্রকৃতির চোখে বিশৃঙ্খলা স্থিতিশীল। চারিদিকে সুষমভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে পরার মাধ্যমেই প্রকৃতি সাম্যাবস্থায় পৌঁছাতে চায়। তাপগতিবিদ্যায় আদর করে এই বিশৃঙ্খলার পরিমাপকে এন্ট্রোপি (entropy) বলে ডাকা হয়। এর কোন বাংলা প্রতিশব্দ আমার জানা নেই। এন্ট্রোপি সর্বদাই ক্রমবর্ধমান। কোন পদার্থ পোড়ালে বা উত্তপ্ত করলে বস্তুত এর এন্ট্রোপি বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করা হয়। আবার এন্ট্রোপির কারণেই প্রকৃতিতে কোনকিছু চিরস্থায়ী হয় না, মানুষো চিরঞ্জীব হয় না। কোটি কোটি বছর পর, আমাদের শান-শাওকাত, বাড়ি-গাড়ি, গণভবন, বঙ্গভবন, সংসদভবন, বিলাসবহুল সুউচ্চ অট্টালিকা, বুর্জ খলিফা, ট্রাম্প টাওয়ার, পৃথিবী, সৌরজগৎ, আকাশগঙ্গা (milky-way galaxy), এমনকি গোটা মহাবিশ্বের সবকিছুই ক্ষয়ে ক্ষয়ে গুড়েবালিতে পরিণত হবে। আমার এই লেখাগুলোও একসময় এন্ট্রোপির অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে। মহাবিশ্বের এরকম নৈরাশ্যবাদী অন্তিম পরিণতিকে বিজ্ঞানের ভাষায় তাপীয় মৃত্যু (Heat Death) বলা হয়। মহাবিশ্বের সম্ভাব্য অন্তিম পরিণতিগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এ নিয়ে আজ আর বিস্তারিত আলোচনা করছি না। বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে কোন এক সময় বিস্তারিত বলব। সত্যি কথা বলতে কি, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শাশ্বত নিয়মের সামনে আমাদের বুক ফুলিয়ে গর্ব করার মতো তেমন কিছুই নেই। পরমশূন্য তাপমাত্রা আমাদের বাড়ির পিছন দরজা আটকে রেখেছে, আর সামনের দরজা পাহাড়া দিচ্ছে স্বয়ং এন্ট্রোপি। আমাদের সামনে পালানোর কোন পথ খোলা নেই। আমরা প্রকৃতির কারাগারে চিরস্থায়ীভাবে বন্দী। এরপর কেউ যদি বলে বসেন প্রকৃতি আমাদের খুব ভালোবাসে, তাহলে আমি অবশ্যই তার কথাটি এক চিমটি লবণের সাথে গলাধঃকরণ করব। শুনতে খারাপ লাগলেও, আমাদের জীবন আসলে পরম শূন্য তাপমাত্রা ও এন্ট্রোপির মধ্যে বিরাজমান এক ক্ষণস্থায়ী তাপগতীয় টানাপোড়ন ছাড়া আর কিছুই নয়! সে যাই হোক, কিন্তু মানব সভ্যতার সামগ্রিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে এই আবিষ্কারগুলো কিন্তু খুবই সাম্প্রতিক। এই আবিষ্কারগুলো থেকে পাওয়া উপলব্ধি ও বিশ্বছবি (worldview) আরো অনেক বেশী সাম্প্রতিক। অতএব তাপগতিবিদ্যা যদি আপনাকে অস্তিত্বের সংকটে ভোগায় তাহলে আমাকে দোষারোপ করতে পারবেন না কিন্তু! এজন্যই আমি বলি, বিজ্ঞান পড়া বাদ দিয়ে সাহিত্যচর্চা করুন, ইগো বাঁচান! আর নয়ত মমতাজের গান শুনুন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মমতাজের গানে বিজ্ঞান খুঁজে পাওয়ার পর থেকে আমি এখন তার গানগুলোকে খুব সিরিয়াসলি নেই।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, মৃত মানুষের দেহ নিস্তেজ, নিরুত্তাপ ও শান্ত-সমাহিত। রিগর মরটিসের (Rigor Mortis) অন্যতম লক্ষণই হল হিমশীতল দেহ। ডাক্তাররা এসব আমার চেয়েও ভালো জানেন। যেখানে তাপ অনুপস্থিত সেখানে প্রাণের স্পন্দন নেই, পরিবর্তন নেই, বিবর্তন নেই। তাপ ছাড়া সবকিছুই নিশ্চল, স্থবির। তাপের স্ফুলিঙ্গই যেন প্রাণের প্রতিচ্ছবি! এ থেকে সহজেই বুঝা যায় প্রাচীনকালের মানুষেরা কেন আত্মাকে জ্যোতির্ময় উত্তপ্ত অগ্নিশিখা হিসেবে কল্পনা করেছিল! শুধুমাত্র তাপের উপস্থিতিই যে নান্দনিক প্রাণোচ্ছলতার জন্ম দিতে সক্ষম, তা তাদের শতাব্দীপ্রাচীন কৌতূহলী চোখেও ধরা পরেছিল নিশ্চয়ই।


Writer: Monzurul Alam

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম