মৃদুল বাবু। বয়স পঞ্চান্ন। পেশায় উপজেলা অফিসের কেরানি ।কাজে তিনি খুব নিষ্ঠাবান-প্রতি
উপরের ঘটনাটা তো পড়লেন, কি মনে হয় মৃদুল বাবুর ভাবনাই ঠিক? উনি কি ঘুমিয়ে গেছিলেন?আসল ঘটনাটা হচ্ছে, হ্যাঁ,তিনি এক অর্থে "ঘুমিয়েই" গেছিলেন-তবে সেটা ছিলো কৃত্রিম ঘুম, কিছু বিশেষ পদার্থ দিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়েছিলো তাকে।এটিই মূলত আমার আলোচনার নিউক্লিয়াস "অ্যানেস্থেশিয়া "র মৌলিক ধারণা!এটি হলো সেই যুগান্তকারী আবিষ্কার যার মাধ্যমে এরকম কোটি কোটি মৃদুল বাবুকে কোনো প্রকার ব্যথা-যন্ত্রণা ছাড়াই অপারেশন করে স্বাচ্ছন্দ্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে।
প্রথমে আসি অ্যানেস্থেশিয়া জিনিসটা কী? খায়? না গায়ে মাখে? অ্যানেস্থেশিয়া (Anesthesia) একটি গ্রীক শব্দ,যার মানে হলো "সংবেদনহীন"। এটি মূলত এমন একটি অবস্থা যা চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় যেখানে একজন রোগীকে অস্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে অজ্ঞান(অবেদন) করা হয়।একাজে যেসব জিনিস ব্যবহার করা হয়, তাদের বলা হয় অবেদনিক বা অ্যানেস্থেটিক(ইংরেজি: anesthetic) এগুলো হচ্ছে এমন কিছু দ্রব্য(যেমন ডাই ইথাইল ইথার,সালফিউরিক ইথার,ইথার থেকে তৈরি করা অন্যান্য কিছু দ্রব্য,নাইট্রাস অক্সাইড,অ্যালকো হল,কোকেন ইত্যাদি যা ব্যবহার করে অবেদন সৃষ্টি করা যায়। অন্যকথায় অবেদনিকের ফলে কিছু সময়ের জন্য সংজ্ঞা অথবা চেতনা হ্রাস পায়।অপারেশনের সময় যখন মানুষের শরীরের কোন বিশেষ অংশ কাটা হয় তখন যে ব্যথা হয় অ্যানেস্থেশিয়া না দিলে সে তা সহ্য করতে পারে না।।অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগের ফলে মাংসপেশিগুলো শিথীল হয়ে আসে। রোগী একধরনের ঘোরের মাঝে চলে যায়, ফলে সে আর ব্যথা কিংবা কোনোরূপ স্পর্শানুভূতি টের পায় না।
ধারণা করতে পারেন, কেমন ছিলো প্রাক-অ্যানেস্থিশিয়া যুগের চিকিৎসা?এখনকার যুগের সাথে তুলনা করলে সেটাকে বলতে হবে "বীভৎস" এবং হয়তো লিখেও দেওয়া লাগতে পারে, "দুর্বল-হৃদয় ব্যক্তিদের জন্য নহে"!সেসময় একজন মানুষের হাত-পা বা শরীরের যেকোনো স্থানে কাঁটাছেঁড়া করা হতো সম্পূর্ণ চেতন অবস্থায়।ব্যক্তি র আর্ত-চিৎকার আর কাতরানোর মধ্যে দিয়েই অপারেশন করতে হতো।আফিম,পপি,কি ছু বিশেষ ফল কিংবা মদের নেশা তৈরি করার রীতি প্রচলিত ছিলো,(হিপনোসিস এর কথাও পাওয়া যায় কোথাও কোথাও!) তবে সেটা ততটা কার্যকর ছিলো না।ব্যথা কিংবা অপারেশনের সেই স্মৃতি একজন রোগী আর কখনো ভুলতে পারতো না।সেই সময়ে একজন বিখ্যাত সার্জন ছিলেন রবার্ট লিস্টন। অ্যানেস্থেসিয়া না ব্যবহার করায় যত দ্রুত অপারেশন করা যেতো রোগীর কষ্ট তত কম হতো এবং রবার্ট লিস্টন ছিলেন এই বিষয়ে বিশেষভাবে পারঙ্গম।তার অপারেশন প্রসিডিউর এত দ্রুত ছিল যে, ছোট খাট অপারেশন মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শেষ হতো।একবার লিস্টনের কাছে এক রোগী আসেন গলায় টিউমার নিয়ে।ঠিক কি হয়েছে সেখানে-- লিস্টনের সহযোগীর সাথে এই নিয়ে মতবিরোধ এবং তর্কের একপর্যায়ে লিস্টন পকেট থেকে সার্জিকাল ছুরি বের করে সেই রোগীর ক্যারোটিড আর্টারী কেটে ফেলেন !রোগী তখন মারা যায়।রোগী মারা গেলেও ক্যারোটিড আর্টারিটা বেঁচে আছে এখনো ফরমালিনের কল্যাণে!(সেই ক্যারোটিড আর্টারী এখনো আছে Liston University College Hospital pathology museum, specimen No. 1256!)
১৮৪৬ সালের ১৬ অক্টোবর, অ্যানেস্থেশিয়ার আবির্ভাবের দিন(এর আগেই অবশ্য আরো অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে গেছে, তবে এদিনটিকেই বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়!) । বস্টনের দন্ত চিকিৎসক থমাস মর্টন সেদিন অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগের একটি সফল প্রদর্শনী ঘটান।১৬ই অক্টোবর প্রতিবছর পালিত হয় অ্যানেস্থেশিয়া দিবস হিসেবে।যাহোক, মর্টনের উদ্ভাবিত বিষয়টি সেই সময়ে ছিলো যুগান্তকারী।অ্যানেস্থেশিয়া যখন আবিষ্কার হয়নি, তখনকার চিকিৎসা কেমন ছিলো, আগেই আলোচনা করেছি।ধীরে ধীরে হাজারো পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে অপারেশনের পূর্বে মানুষকে অচেতন করা নিয়েই, গড়ে উঠেছে অ্যানেস্থেশিয়ার সম্পূর্ণ পৃথক এক বিভাগ।
বর্তমানে দুই ধরনের অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগের বিধান রয়েছে; লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া ও জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়া( উল্লেখ্য যে সিডেশন বলে আরো একধরণের অ্যানেস্থেশিয়া পদ্ধতিরও উল্লেখ পাওয়া যায় কোথাও কোথাও!)শরীরের নির্ধারিত কোনো অংশকে যখন অচেতন করা হয় তখন তাকে বলে লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া। এক্ষেত্রে পুরো শরীর অচেতন করবার কোনো প্রয়োজন হয় না। লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া যে স্থানে প্রয়োগ করা হয়, তাকে যে স্নায়ু স্পর্শানুভূতি দিয়ে থাকে, অ্যানেস্থেশিয়ার মাধ্যমে সেই স্নায়ুকে সাময়িক অকেজো করে দেয়া হয়। ফলে অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগকৃত স্থান থেকে কোনোরূপ স্পর্শানুভূতি নিয়ে স্নায়ুটি আর মস্তিষ্কে যেতে পারে না । ডেন্টিস্টগণ হরহামেশাই রুট ক্যানেলের সময় নোভোকেইন ব্যবহার করে থাকেন, এই নোভোকেইন মুখ গহ্বরের নার্ভগুলোকে সাময়িক অকেজো করে রাখে। ফলে রুট ক্যানেল করার সময় একজন রোগী আর ব্যথা পায় না।
অপরদিকে যখন কোনো অপারেশনে পুরো শরীর অচেতন করার প্রয়োজন দেখা দেবে, তখন যে অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগ করা হয় সেটি হলো জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়া( GA) ।এটি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের উপর কাজ করে এর ক্রিয়াকলাপকে সাময়িকভাবে স্তব্ধ করে দেয়, ফলে রোগী অজ্ঞানতা এবং সংবেদনহীনতা অনুভব করে। এই অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগে রোগীর অপারেশনের ব্যাপারে কোনো স্মৃতি মনে থাকে না।লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগে আপনি পুরোপুরি অচেতন হবেন না, কেবলমাত্র শরীরের নির্দিষ্ট অংশ অবশ হয়ে থাকবে। আর যদি জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগ করা হয়, তাহলে আপনার স্মৃতি ঘেঁটে দেখুন, পনেরো থেকে উল্টো গণনা করার স্মৃতিটুকুই হয়তো মনে আছে, আর কিছু মনে থাকবে না। বিশাল এক ঘুম দিয়ে জেগে উঠেছেন আপনি, আনন্দের ব্যাপার হলো আপনার অপারেশন শেষ!(মৃদুল বাবু, আপনার কাহিনী আমরা বুঝে ফেলেছি!)
বর্তমানে দুই ধরনের অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগের বিধান রয়েছে; লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া ও জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়া(
অপরদিকে যখন কোনো অপারেশনে পুরো শরীর অচেতন করার প্রয়োজন দেখা দেবে, তখন যে অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগ করা হয় সেটি হলো জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়া(
অ্যানেস্থেশিয়াগুলো বর্তমানে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে তিনভাবে। নির্ধারিত অঙ্গের অনুভূতি দানকারী নার্ভে; শ্বাস-প্রশ্বাসে র সঙ্গে; ও শিরায় ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে।
মস্তিষ্ক স্নায়ুতন্ত্রের অসংখ্য নার্ভের মাধ্যমে পুরো শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, সেই সাথে পুরো শরীরে উদ্দীপক অনুসারে যথাযথ প্রতিক্রিয়া প্রদান করে থাকে মস্তিষ্ক। কোথাও আঘাত পেলে সঙ্গে সঙ্গে সেই স্থানের সংবেদী স্নায়ু(sensory nerve) অনুভূতি পৌঁছে দেয় মস্তিষ্কের পেইন রিসেপ্টরে। এভাবেই আমরা বুঝতে পারি ব্যথার অনুভূতি। সকল অনুভূতি নার্ভের মাধ্যমে মস্তিষ্কে যাতায়াত করে ইলেক্ট্রো-কেমিক্যাল সিগন্যাল হিসেবে। শরীরের যে অংশটি অচেতন করার প্রয়োজন হবে, সেখানকার নার্ভে যদি এমন কোনো বাধা'র ব্যবস্থা করা যায় যার দরুন স্নায়ুটি সাময়িকভাবে মস্তিষ্কের সঙ্গে যোগাযোগে অক্ষম হয়ে পড়বে,তাহলেই সেই স্থানের অনুভূতি আর মস্তিষ্কে পৌঁছাবে না।আর ঠিক এভাবেই লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া করা হয়, কিন্তু যদি শরীরের পুরো স্নায়ুতন্ত্রকে সাময়িকভাবে বিরত রাখতে হয় তখন আর এই পদ্ধতি অনুসৃত হয় না। শ্বাস-প্রশ্বাসে র সঙ্গে ধ্রুব হারে অচেতনকারী গ্যাসীয় পদার্থের চালনার মাধ্যমে এমনটি করা হয়ে থাকে।
সালফিউরিক ইথারের ব্যবহার দিয়ে সফল যাত্রা শুরু করেছিলো অ্যানেস্থেশিয়া। বর্তমানে ইথার শ্রেণির ডাইইথাইল ইথার ব্যবহৃত হয় সরাসরি প্রশ্বাসের সঙ্গে।সেই সাথে ইথার থেকে তৈরিকৃত ‘সেভুফ্লুরেন’ ব্যবহৃত হয় জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়ায় ।এছাড়া রয়েছে নাইট্রাস অক্সাইড।এই গ্যাসটি ‘লাফিং গ্যাস’ নামে পরিচিত। এই লাফিং গ্যাস এখনো অ্যানেস্থেশিয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে প্রয়োজন অনুসারে।একসময় ক্লোরোফর্ম ব্যবহার করা হতো এ কাজে, এখোনো হয়ে থাকে টুকটাক, তবে এই গ্যাসটি বাতাসে বিক্রিয়া করে বিষাক্ত "ফসজিন গ্যাস" তৈরি করে ফেলে বিধায় এর উপযুক্ত ডোস নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।তাই এর ব্যবহার এখন তুলনামূলক কম।এছাড়া জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়ায় শিরায় দুই ধরনের তরল পদার্থ ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। একটি হলো প্রোপোফল, অপরটি ফেন্টেনিল। প্রোপোফল রোগীকে অচেতন করে তোলে আর সেই সাথে ফেন্টেনিল প্রয়োগে অচেতন অবস্থায় রোগীর অনুভূতি যাতে মস্তিষ্কে না পৌঁছাতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হয়।
মস্তিষ্ক স্নায়ুতন্ত্রের অসংখ্য নার্ভের মাধ্যমে পুরো শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, সেই সাথে পুরো শরীরে উদ্দীপক অনুসারে যথাযথ প্রতিক্রিয়া প্রদান করে থাকে মস্তিষ্ক। কোথাও আঘাত পেলে সঙ্গে সঙ্গে সেই স্থানের সংবেদী স্নায়ু(sensory nerve) অনুভূতি পৌঁছে দেয় মস্তিষ্কের পেইন রিসেপ্টরে। এভাবেই আমরা বুঝতে পারি ব্যথার অনুভূতি। সকল অনুভূতি নার্ভের মাধ্যমে মস্তিষ্কে যাতায়াত করে ইলেক্ট্রো-কেমিক্যাল সিগন্যাল হিসেবে। শরীরের যে অংশটি অচেতন করার প্রয়োজন হবে, সেখানকার নার্ভে যদি এমন কোনো বাধা'র ব্যবস্থা করা যায় যার দরুন স্নায়ুটি সাময়িকভাবে মস্তিষ্কের সঙ্গে যোগাযোগে অক্ষম হয়ে পড়বে,তাহলেই সেই স্থানের অনুভূতি আর মস্তিষ্কে পৌঁছাবে না।আর ঠিক এভাবেই লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া করা হয়, কিন্তু যদি শরীরের পুরো স্নায়ুতন্ত্রকে সাময়িকভাবে বিরত রাখতে হয় তখন আর এই পদ্ধতি অনুসৃত হয় না। শ্বাস-প্রশ্বাসে
সালফিউরিক ইথারের ব্যবহার দিয়ে সফল যাত্রা শুরু করেছিলো অ্যানেস্থেশিয়া।
প্রতিবছর ই অ্যানেস্থেশিয়া চিকিৎসা উন্নত হচ্ছে। ধীরে ধীরে নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কার হচ্ছে, যার ফলে মানুষের অপারেশন ভীতি অনেকটাই কেটেছে। অ্যানেস্থেশিয়া চিকিৎসার সফলতা অনেকাংশেই নির্ভর করে অ্যানেস্থেশিওলজিস্টের দক্ষতা, যোগ্যতার ওপর।একজন দক্ষ অ্যানেস্থেশিওলজিস্ট ই পারেন সঠিক অনুপাতে মিশ্রিত অ্যানেস্থেশিয়া দিয়ে রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিতে।বিজ্ঞানের এই সুহান আবিষ্কারটির সদ্ব্যবহার এবং অ্যানেস্থেশিয়া চিকিৎসকদের যথার্থ মানোন্নয়ন আজ সময়ের দাবি!
বিজ্ঞানের জয় হোক!
বিজ্ঞানের জয় হোক!
Writer: Anirban Maitra