![]() |
কালমেঘ পাতা ও ফুল |
১৯১৮ সালের কথা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘনঘটা শেষ, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মানুষ যখন স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তন করছে ঠিক তখনই আঘাত হানল স্প্যানিশ ভাইরাস। ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল ফ্রান্স হলেও প্রচারে প্রাধান্য পেল স্পেন। এ-দেশের নামটা জড়িয়ে গেল মুখে মুখে আর কাগজপত্রেও। ভারতে তখন প্রচণ্ড খরা চলছে কিছু অঞ্চলে, তাতে হয়ত যোগসাজস ছিল আবহাওয়া বিধ্বংসী এলনিনো-র।
ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ মনে করেন, এই প্রাণঘাতক রোগটা বিস্তার লাভ করেছে দূরদূরান্তে ভ্রাম্যমাণ সৈনিকদের মাধ্যমে। যুদ্ধরত অবস্থায় খাদ্যঘাটতি আর অনিয়মে তাদের রোগপ্রতিরোধক ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণেই এই রোগের শিকার হয়েছিল অসংখ্য সৈনিক। বিশ্বযুদ্ধে যত লোক মারা গেল তার ১০ গুণ লোক মারা গেল ভাইরাসে। প্লেগ রোগে যত লোক মারা গেল তার চারগুণ বেশি মারা গেল স্প্যানিশ ভাইরাসে।
আঞ্চলিক এই মহামারী ক্রমে গোটা বিশ্বকে গ্রাস করল, প্রাণ হারালো প্রায় ৫ কোটি লোক। ভারতবর্ষেও মারা গেল প্রায় দেড় কোটি। ঠোঁটে জান নিয়ে মানুষ যখন অহরহ পরকালের অপেক্ষায় দিন গুনছে তখন হঠাৎ করে তারা এক ভেষজ চিকিৎসায় আরোগ্য হতে শুরু করল, বেঁচে গেল কোটি কোটি অসহায় মানুষ। এই অনন্য ভেষজের নাম কালমেঘ (Andrographis paniculata) যার সঙ্গে সাহায্যকারী হিসাবে এল আরেকটি ভেষজ, ইন্ডিয়ান জিনসেং যাকে আমরা চিনি অশ্বগন্ধা (Withania somnifera) নামে। ভেষজ জগতের এমন রোমহর্ষক কাহিনী এখন নিশ্চিত করে প্রমাণ করার মতো অবস্থা নেই। কিন্তু এই ঘটনা বিশ্লেষণ ও গবেষণা করে স্ক্যান্ডিনেভিয়া অর্থাৎ ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন ইত্যাদি দেশগুলিতে শীতকালীন অসুখ ফ্লু-র বিরূদ্ধে এর ব্যবহার শুরু হয়েছে প্রায় এক যুগ আগে থেকে। ইতিপূর্বে ঐসব দেশে স্থানটি দখল করেছিল অন্য একটি ভেষজ একিনেশিয়া। কালমেঘকে এখন তারা আত্তীকরণ করে বলে “ইন্ডিয়ান একিনেশিয়া”। সমসাময়িক কালে চীনও কালমেঘ নিয়ে গবেষণা করল, ব্যবহার করল এবং চাষাবাদও শুরু করল। ভারত ও শ্রীলঙ্কার নেটিভ গাছ কালমেঘের চাষ এখন শুরু হয়েছে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজেও। ইউরোপ আমেরিকাতে এর চাষ দু'দশক আগে শুরু হলেও অচিরেই ব্যাপক চাষাবাদের সম্ভাবনা রয়েছে।
ভারতবর্ষে চিকিৎসা-ক্ষেত্রে কালমেঘকে ব্যবহার করেছে AYUSH-এর পুরো পরিবার, আয়ুর্বেদ, ইউনানি, সিদ্ধা ও হোমিওপ্যাথি। চীনের হি-ফেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা জানিয়েছে, এর ভেতরে রয়েছে অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি, ইমিউনো স্টিমুলেটরি, অ্যান্টি ভাইর্যাল, অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টি প্লেটলেট, অ্যান্টি ক্যান্সার এবং লিভার রক্ষাকারী গুণাবলী। প্রাচীনকাল থেকেই আমরা নিম নিশিন্দা চিরতা কালমেঘকে দেহের উপকারের জন্য ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করেছি, আবার খাদ্য হিসাবেও ব্যবহার করি কিছু মৃদু তিতা যেমন, করল্লা বাঁধাকপি হলুদ মেথি কোকো পালং ইত্যাদি। আগেকার দিনে চীন এবং ভারতে খাবার মেন্যুতে নিয়মিতভাবে থাকত কিছু না কিছু তিতা খাবার। এখন আমরা ভিন্ন খাবারে রসনার সন্ধান করি, ভুলে যাই স্বাস্থ্যবিধির উত্তরাধিকার।
এসব তিতা খাবার পাচকরস নির্গমনে সহায়তা করে এবং ক্ষুধার প্রাবল্য কমিয়ে দেয় বলে এতে দেহে মেদ জমার সম্ভাবনা কমে যায়, রক্তকেও বিষমুক্ত করে... কথাগুলি বলেছেন পথ্যবিদ নিকোল দুব ( Nicole Dube)। দুব জানিয়েছেন, হজমের গোলমাল থাকলে খাবার সঙ্গে সিংহদন্তী বা ড্যান্ডেলায়নের পাতাকে কিছুদিন সালাদ হিসাবে খাওয়ার জন্য, যা তিতাস্বাদযুক্ত।
আয়ুর্বেদ কালমেঘকে ব্যবহার করেছে বিভিন্ন রকম পেটের পীড়ায়, অম্ল অজীর্ণ আমাশয় এবং দূষিত জ্বরে। দেশ-গাঁয়ে এর ব্যবহার ছিল সীমিত ও সাধারণ। যে কোনো প্রকার কৃমিনাশের জন্য এর পাতার ৩০ ফোঁটা রস কাঁচা হলুদের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ানো ছিল নৈমিত্তিক ওষুধের মতো। এখন গবেষণা থেকে জানা গেছে তার অসংখ্য উপকারী দিক, ক্যান্সার এইডস সিফিলিস হৃদরোগ ইত্যাদি কঠিন রোগ নিরাময়ের। কালমেঘের ভেতর সবচে জরুরি উপাদান হল এন্ড্রো.গ্রাফোলয়েড যা পাতাতেই সবচে' বেশি থাকে। এটা ভাইরাস দমন করে, এবং এর ভবিষ্যৎ বৃদ্ধিও বন্ধ করে দেয়। আবার করোনারি এঞ্জিওপ্লাস্টির পরে যাতে রক্তনালি চেপে না যায়, রক্তস্রোতে প্লেটলেট জমে গিয়ে ধমনী বন্ধ হয়ে না যায় সেজন্য এর একটি বিশেষ ব্যবহার আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে চলে এসেছে।
কালমেঘ নিয়ে পিছিয়ে থাকা গবেষণা এখন যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। তবে এসব গবেষণার বেশিরভাগই হচ্ছে ইঁদুরের ওপর। পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় ইঁদুরের শরীরে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি পরিমাণ রসায়ন ব্যবহার করা হয় যা মানুষের ক্ষেত্রে করা হয় না। মানুষের জন্য বিভিন্ন রোগে ওষুধের পরিমাণ ও মাত্রা বের করা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। যেহেতু 'ডোজ' নির্ধারণ এখনো সঠিকভাবে সম্ভব হয়নি তাই স্বীয় উদ্যোগে দীর্ঘদিনব্যাপী এর অবিরাম ব্যবহার ক্ষতিকারক হতে পারে। সে কারণে সপ্তাহে দুদিন বা মাসে অন্তত এক সপ্তাহ বিরতির প্রয়োজন আছে। যাদের অণুচক্রিকা সংখ্যায় কম তাদের এবং শিশুদের এই ভেষজ ব্যবহার করা সঙ্গত নয়। গর্ভবতীদেরও কালমেঘ ব্যবহারে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া ভাল কারণ এতে গর্ভপাতের সমূহ আশঙ্কা থাকে।
কালমেঘ বর্ষজীবী গাছ, মিটার খানেকের বেশি উঁচু হয় না কখনো। খুব ছোট ফুটকি ফুল হয় যার কেশরের আকৃতি থেকেই অ্যান্ড্রোগ্রাফিস জেনাস-এর নাম এসেছে। (অ্যান্ড্রো = মেল, গ্রাফিস = স্টাইলাস)। কালোমেঘ যত্রতত্র ঊষর মাটিতেও (Serpentine soil) অনায়াসে জন্মায় যাতে থাকতে পারে অ্যালুমিনাম, কপার ও জিঙ্ক। কখনো বড় গাছের নিচে, সেগুনবাগানে স্বল্প আলোতেও একে চাষ করা যায়। বীজকে এক রাত পানিতে ভিজিয়ে রেখে রোপন করলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় পাঁচ-সাত দিনের ভেতরেই। এই অবহেলিত অথচ অসাধারণ ভেষজটি কৃষিজাত করতে পারলে বাংলাদেশে চিকিৎসা জগতের একটি উল্লেখযোগ্য ভেষজ-অভাব পূরণ হতে পারে।
Zayed Farid
Bangladesh University of Engineering and Technology