আপনি কি জানেন এখনকার অঙ্কগুলোর আকৃতি কীভাবে এসেছে? আপনি কি জানেন এগুলোর প্রত্যেকটিতে নিজ মানের সমান সংখ্যক কোণ রয়েছে?
কোণ এর দ্বারা আরবীয় নিউমেরালের ইতিহাস বা নির্মাণশৈলীর ব্যাখ্যা অনেকসময়ই বিভিন্ন জায়গায় হাওয়া-বাতাস খেতে দেখা যায়। সেটা পোস্ট করলে আবার নেটিজেনদের ওয়াও-এর বন্যা ভাসা শুরু হয়! আমরা প্রথমে একটু লজিক্যালি ব্যাপারটা দেখার চেষ্টা করব যে আসলেই এটি সত্যি কি না। এরপর ইতিহাস থেকে তথ্য নিয়ে যাচাই করব।
একটা কথা বলে রাখি, ইংরেজিতে নিউমেরাল মানে বুঝায় “a figure, symbol, or group of figures or symbols denoting a number.” অর্থাৎ সংখ্যার লিখিত রূপ বা চিহ্ন। আমাদের আলোচনায় নিউমেরাল দ্বারা নিউমেরিকাল ডিজিটকে বোঝানো হচ্ছে এবং এর বাংলা হিসেবে অঙ্ক ব্যবহার করা হচ্ছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে is nich wahr এর মানে হলো is not true!
হ্যাঁ দেখাই যাচ্ছে উনারা ফানকে কীরকম সিরিয়াসলি নেন! যাইহোক, প্রথমত ছবিটার দিকে তাকালে প্রথমেই কি মনে আসছে না যে এটাতে অঙ্কগুলোর চেহারা এরকম করা হয়েছে শুধুমাত্র কোণের সংখ্যা মেলানোর জন্য?
1- কেই ধরা যাক। এখানে যে দেখানো হয়েছে ‘একটা কোণ’ সেটাও আসলে ঠিক না, কারণ এখানে একটি প্রবৃদ্ধ কোণ আর আরেকটি ভেতরের দিকে সূক্ষ্ণকোণ। আবার সরলকোণকে হিসেবে আনলে, এখানে 2 টি রেখা তাই 2 টি সরলকোণ রয়েছে, অর্থাৎ 1-এর চিহ্নে 4 টি কোণ রয়েছে!
আচ্ছা, এতো খুঁতখুঁতে নাহয় হলাম না। কিন্তু 7 আর 9 এর দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে ব্যাপারটা আরো বিশ্রী হয়ে যায়। 7 এর মাঝের দাগটা 1 এর সাথে প্যাঁচ যাতে না লেগে যায় সেজন্য বর্তমানে মাঝেমাঝে এটি ব্যবহার করা হয়। আর নিচের দাগটা ব্যাপারটাকে আরো জঘন্য করে তুলেছে, এটাকে সর্বোচ্চ ফন্ট ডেকোরেশন বলা যায়, এভাবে 7 লেখার প্রচলন কখনো ছিলোনা, নেই। আর এই এলিয়েন 9 এর কোণ মেলানোর জন্য এর নিচের লেজ লাগিয়ে দেয়ার ফলে এটি একটি উদ্ভট আকৃতি ধারণ করেছে! কী সৃজনশীলতা!
আর একটা ব্যাপার খুবই অদ্ভুত না যে অঙ্কগুলো সরলরেখার সমন্বয়ে গঠিত? মানে স্বাভাবিকভাবেই সরলরেখা-বক্ররেখা মিলে, মানে সবচেয়ে এফিশিয়েন্ট, অঙ্ক তৈরি হবে এবং সেভাবেই অংকের আকৃতি হওয়ার কথা, বক্ররৈখিক ও সরলরৈখিকের মিশ্রণ। কিন্তু এক্ষেত্রে এটাও মেকি মনে হচ্ছে শুধুমাত্র সরলরেখা দিয়ে অঙ্কগুলো লেখার জন্যে। আর তাহলে 0 কেন বক্ররৈখিক? ওটা তো একটা আয়ত হওয়ার কথা!
তাছাড়া অঙ্কগুলো যদি কোণ এর ভিত্তিতে গঠিত হয়েও থাকে তাহলে আকৃতি নির্দিষ্ট করবে কী করে (যেমন 2 এর আকৃতি হতে পারে নিচের চিত্রের মতন।)? আর কারা করবে? অঙ্কগুলোর আকার আকৃতি তো রাজসভায় মিটিং ডেকে, নিয়ম করে, নির্ধারণ করা হয় না। এরও বিবর্তন হয় এবং তা হয় স্বতস্ফূর্তভাবে- প্রাণীর বিবর্তনের মতোই!
2-কোণওয়ালা 2?!
কিন্তু ইতিহাস তো আর সবসময় যুক্তিমাফিক হয় না! মজার ব্যাপার হচ্ছে ইতিহাস অনুযায়ী কোণের ব্যাপারটা সত্য!
আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে উপরের মজার ব্যাপারটা মজা করার জন্যই বলা, উহা আসলে ঠিক নয়!
তো এখন আসা যাক তথ্যসূত্রভিত্তিক যাচাইকরণে।
আরবীয় অঙ্ক বা নিউমেরালগুলোর উৎপত্তি আসলে ভারত থেকে। যদিও মূল উৎপত্তি ভারত থেকে, তবে এখন সাধারণত এ সংখ্যাব্যবস্থাকে হিন্দু-আরবীয় সংখ্যা পদ্ধতি হিসেবেই ডাকা হয়। কারণ এ পদ্ধতি ভারত থেকে বের করে আনেন আরব গণিতবিদগণ এবং তাঁদের হাত ধরেই এটি ইউরোপে পরিচিত হয় এবং বিশ্বব্যাপী বিস্তার ঘটে।
এর অঙ্কগুলো আসে ব্রাহ্মী সংখ্যাব্যবস্থা থেকে এবং মধ্যযুগের পর বিভিন্ন ধরণের লিপিতে বিভক্ত হয়ে যায়। এ সংখ্যাব্যবস্থার একটি বিশেষ দিক হলো সংখ্যাগুলোতে অংকের স্থানীয় মানের ব্যবহার থাকা। এবং সেটা দেখা যায় ‘বাকশালি পান্ডুলিপি’-তে। যদিও এ পান্ডুলিপি ঠিক কখন তৈরি হয় তা এখনো অনিশ্চিত।
বাকশালি পান্ডুলিপি
ভারতীয় গণিতবিদগণ প্রথম থেকে চতুর্থ শতাব্দীর দিকে হিন্দু-আরবীয় সংখ্যাব্যবস্থা উদ্ভাবন করেন। অবশ্যই এটি কোনো সাময়িক পরিশ্রমের ফসল না। প্রক্রিয়াটা ক্রমাগত বহমান নদীর মতো- হুট করে শেষ বা শুরু হয় না। এবং এইভাবে এ সংখ্যাব্যবস্থাটি আরো পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত হতে থাকে। অষ্টম থেকে নবম শতাব্দীর দিকে এই সংখ্যাব্যবস্থার উত্থান ঘটে এবং তখন এটিকে একটি দশ-ভিত্তিক সংখ্যাব্যবস্থা হিসেবে দেখা যায়। তবে ব্রহ্মগুপ্তের 0’র প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহার (0’র ব্যবহার নিয়ে বই লিখেন) এ পরিণতিতে মাইলফলক হিসেবে কাজ করে।
এরকম সময়েই আরবরা এই সংখ্যাব্যবস্থা গ্রহণ করে। তবে তখন ভারতেই অনেকরকম পদ্ধতির একই সাথে চল ছিলো। কথিত আছে যে আল বিরুনি বলেন “আরবরা যেটাকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার্য বলে করেছে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে”। আল-খোয়ারিজমি এবং আল-কিন্দি’র মাধ্যমেই প্রথম হিন্দু-আরবীয় পদ্ধতি ভারতবর্ষ ছেড়ে বের হয়। এ সংখ্যাপদ্ধতি নিয়ে আরবরা আরো কাজ করতে থাকে।
আরব থেকে এ নিউমেরালগুলো উত্তর আফ্রিকায় আরব-ভাষাভাষীদের মাঝে ব্যবহৃত হতে থাকে। এবং বলতে গেলে সেখানেই এটি কিছু পরিবর্ধনের ফলে ’আরবীয় সংখ্যাব্যবস্থা’য় পরিণত হয়। আলজেরিয়ার বেজাইয়াতে ফিবোনাক্কি সর্বপ্রথম এ সংখ্যাব্যবস্থার সাথে পরিচিত হন (মানে উনার সর্বপ্রথম পরিচয় ঘটে)। উনি 1202-তে ‘Liber Abaci’ নামে একটি বই লিখেন যেটি হিন্দু-আরবীয় সংখ্যাব্যবস্থাকে পশ্চিমে পরিচিত করতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে। এটা একটা বড় কারণ যে, কেন এ ব্যবস্থার নাম পশ্চিমের কাছে (এখন অবশ্য পুরো বিশ্বেই) ‘আরবীয় সংখ্যাব্যবস্থা’ হিসেবেই বেশি পরিচিত- কারণ আরবদের হাত ধরেই এ ব্যবস্থা ইউরোপে বিস্তার লাভ করে। এবং ইউরোপ মহাদেশেও এ সংখ্যাব্যবস্থার বিভিন্ন পরিবর্তন, পরিবর্ধন ঘটতে থাকে।
নব্য ইউরোপে এই অঙ্কগুলোর বিবর্তন জন ইতিয়েন্নে মন্তুক্লা (Jean-Étienne Montucla) তাঁর Histoire de la Mathematique বইয়ে দেখিয়েছেনঃ
এক্ষেত্রে সপ্তম সারির অঙ্কগুলো একটু চেনা চেনা লাগছে কি? Chiffres Modernes মানে হলো Modern numbers অর্থাৎ যা আমরা এখন ব্যবহার করি। খেয়াল করলে দেখবেন, এই পথযাত্রায় 8 এর কলামে কোনো ‘X’ আকারের 8 নেই, নেই কোনো বাকানো লেজওয়ালা 9।
এই আলোচনাও খুব সম্ভবত বাড়তি মনে হয়েছে অনেকের কাছে। কারণ এটার যুক্তিমাফিক ব্যবচ্ছেদই এত অসংলগ্নতা বেরিয়ে পড়ে যে দেখেই ভুল বলতে ইচ্ছে করে। তবে সবসময় ইচ্ছা’র প্রতি বায়াসড থাকলে আবার ঠিক ফলাফল নাও আসতে পারে! তাই এই ইতিহাস কপচানো। বোরিং, তাই না?!
তবে সালটাল মুখস্থ না করা লাগলে(!) সংখ্যার, সংখ্যাব্যবস্থার ইতিহাস অপূর্ব। সেসবের কাছ দিয়ে না গিয়ে এধরণের হাইপোথিসিস বা গুজবকে যেমন পুরোপুরি মিথ্যা প্রমাণ করতে পারছেন না, সেই একই যুক্তিতে সেসবের কাছ দিয়ে না গিয়ে জনপ্রিয়তার ঠ্যালায় আর ভাল্লাগে বলে এগুলোকে বিশ্বাসও করা যাবে না, বিশেষ করে যেখান থেকে এই সংখ্যাব্যবস্থার উৎপত্তি সেখানেই বছরের পর বছর এ জিনিস মার্কেট পেলে সেটা বেশ উপহাসের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়!
তথ্যসূত্র:
1. Oxford Languages
2. https://en.wikipedia.org/wiki/Arabic_numerals
3. https://en.wikipedia.org/wiki/Hindu–Arabic_numeral_system
4. https://en.wikipedia.org/wiki/History_of_the_Hindu–Arabic_numeral_system
Writer: Sabyasachi Nirjhar
Tags:
Mathematics