আমার পিএইচডি গবেষণার বিষয়বস্তু হল বিবর্তন। আরো ঠিক করে বললে মলেকিউলার ইভোলিউশান- অর্থাৎ ডিএনএ পর্যায়ে কীভাবে বিবর্তন হয়। আমার ভীষণ পছন্দের বিষয়।
ফেইসবুকে বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখি করার সুবাদে বিগত বেশ ক'মাস ধরে বাংলাভাষী বিজ্ঞান গ্রুপগুলোতে আনাগোনার সুযোগ হয়েছে। সেখানে খেয়াল করেছি- বিবর্তন নিয়ে মানুষের আগ্রহ কৌতূহল আছে বটে, কিন্তু সেটা অন্য জায়গায়। বিবর্তন বলতে মানুষ সচরাচর বোঝে প্রাচীন পৃথিবীর কাহিনী। প্রথম প্রাণ সৃষ্টি, ডাইনোসরদের চেহারা কেমন, মানুষ কবে মানুষ হল- ইত্যাদি।
অথচ বিবর্তনের এই বিষয়গুলোতেই আমার আগ্রহ সবচেয়ে কম। আমার আগ্রহ বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে নয়, বরং এর কলকব্জা নিয়ে। বিবর্তন হয় তো বুঝলাম, কিন্তু কীভাবে হয়? ধরুন একটা প্রাণীর জনসংখ্যায় বিবর্তন হচ্ছে। এই অবস্থায় যদি সেখানকার প্রত্যেকটা প্রাণীর ডিএনএর সামনে একটা ছোট্ট ভিডিও ক্যামেরা বসিয়ে দেই- তাহলে আমরা কী দেখব? ডিএনএর মধ্যে কী কী ধরণের পরিবর্তন কীরকম গতিতে হচ্ছে? এই জাতীয় প্রশ্নে আমার আগ্রহ বেশি।
এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য আমার পছন্দের সিস্টেম হচ্ছে এককোষী জীবাণু।
এর একটা কারণ অলসতা। ইঁদুর-বাদর তো বটেই, পরীক্ষাগারে ছত্রাক পালাও মহা মুসিবতের কাজ। আমার মিসেস কাজ করেন রোগ প্রতিরোধ (ইমিউনোলজি) নিয়ে, তার সকাল বিকেল ইঁদুর কাটার গল্প শুনে এই বড় প্রাণীগুলোর প্রতি আরো বিরক্তি জন্মেছে। জীবাণু পালা তার তুলনায় কিছুই না। আরেকটা কারণ হল ভয়। জীববিজ্ঞান মানেই জটিলতা। প্রাণীতে কোষের সংখ্যা ও প্রকারভেদ যত বেশি, মোটা দাগে তাদের জটিলতা তত বেশি। এই জটিলতাকে আমি বেশ ভয় পাই। একটা জটিল সিস্টেম নিয়ে গবেষণা করে সঠিক উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম, যদি না প্রশ্নটা খুব সহজ হয়।
এককোষী জীবাণু আবার এসব দিক থেকে একদম পার্ফেক্ট। কম্পিউটারে বা পরীক্ষাগারের যাঁতায় পিষে এদের থেকে প্রশ্নের উত্তর বের করা অপেক্ষাকৃত সহজ।
বিবর্তন নিয়ে যে লেখালেখি সেরকম করি না তার অনেকগুলো কারণের মধ্যে এটা একটা। বিবর্তনের মধ্যে আমার পছন্দের বিষয় যেগুলো, সেসব ব্যাপারে মানুষের অত আগ্রহ নেই। ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে বিবর্তনের গতিপ্রকৃতি কী- এরকম ব্যাপারে আজকে পর্যন্ত কাউকে প্রশ্ন করতে শুনেছি বলে মনে হয় না। আবার মানুষের আগ্রহের বিষয়গুলোতে আমার সেরকম আগ্রহ নেই। ডাইনোসরের কতরকম জাত ছিল তা জানতে আমার বয়েই গেছে।
যাই হোক, সামনের সেমিস্টারে আমাকে বিবর্তনের একটা ক্লাসের টিএ (টিচিং অ্যাসিস্টেন্ট) হতে হবে। তার প্রস্তুতিস্বরূপ নিচের ছবিতে দেওয়া বইটা পড়তে হচ্ছে। আমার প্রফেসর নিজেই আমার ঠিকানা বরাবর পাঠিয়ে দিয়েছেন। বইটা উল্টেপাল্টে দেখলাম, এর প্রথমার্ধ্বে জীবাণুর কথাবার্তা সেরকম নেই, শুধু মাছ পাখি গিরগিটি আর সাপখোপের মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ। খানিকটা বিরক্তি নিয়েই আজ পড়তে বসলাম।
প্রথম অধ্যায়েই অবশ্য একটা জিনিস দেখে বিরক্তি মোটামুটি কেটে গেল।
আজ থেকে পঞ্চাশ কোটি বছর আগে- ক্যাম্ব্রিয়ান যুগ যেসময়টাকে বলে- পৃথিবীতে এমন সব প্রাণী পাওয়া যেত, যার সাথে এখনকার পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের আদৌ মিল নেই। যেমন, একটা প্রাণীর বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক লিখেছেন- এটা দেখতে ছিল ভাসমান একখণ্ড গজ কাপড়ের মত, সেই কাপড়ের তলায় আবার গোলাকার একটা মুখ। আরেকটা দেখতে এতই বিটকেলে যে এর বিভিন্ন অঙ্গ যে একই দেহ থেকে এসেছে, সেটাই বিজ্ঞানীদের মানতে বেগ পেতে হয়েছিল। তারা প্রথমে এর অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে তিনটা আলাদা প্রজাতি সাব্যস্ত করে দিয়েছিলেন।
আরেক বেচারার পাঁচটা চোখ আর কাঁটাঅলা লম্বা শুঁড়ময় বিকট চেহারা দেখে উপস্থিত বিজ্ঞানীরা হো হো করে হেসে দিয়েছিলেন।
তবে সবচেয়ে আশ্চর্য বোধহয় আরেকটা প্রাণী। এর দেহ লম্বা একটা টিউবের মত, মাটি থেকে অনেকখানি ওপরে। সেই শুকনো দেহ থেকে পাইপের মত সাতজোড়া পা বের হয়ে মাটি স্পর্শ করেছে। দেহের ওপরের দিকে আবার পায়ের সাথে মিল রেখে সাত সারি কাঁটা দাঁড়িয়ে আছে- বোধহয় শিকারীদের তাড়ানোর জন্য।
এর মাথা কোনদিকে আর ল্যাজ কোনদিকে বোঝার কোন উপায় নেই।
এই প্রাণীটার কথা প্রথম এসেছিল উনিশশ' সাতাত্তরের এক গবেষণাপত্রে। পড়ে জানতে পারলাম, প্রথমবার বিজ্ঞানী ব্যাটাকে সঠিকভাবে জোড়া দিতে পারেননি- পা আর কাটা উলটে দিয়েছিলেন। তবে এর মাথা যে আসলে কোনদিকে সেটা আরো অনেকদিন অমীমাংসীত ছিল। এই সেদিন এক গবেষণাপত্রে বিষয়টার ফয়সালা হয়েছে।
প্রাণীটার নাম দেওয়া হয়েছে হ্যালুসিজেনিয়া। গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানী এরকম নামকরণের কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেছেন- Hallucigenia refers to the bizarre and dream-like appearance of the animal.
হ্যালুসিজেনিয়ার বিবরণ পড়ে এই কবিতাটার কথা মনে পড়ে গেল-
Glory be to God for dappled things –
For skies of couple-colour as a brinded cow;
For rose-moles all in stipple upon trout that swim;
Fresh-firecoal chestnut-falls; finches’ wings;
Landscape plotted and pieced – fold, fallow, and plough;
And all trades, their gear and tackle and trim.
All things counter, original, spare, strange;
Whatever is fickle, freckled (who knows how?)
With swift, slow; sweet, sour; adazzle, dim;
He fathers-forth whose beauty is past change:
Praise him.
(Pied beauty, Gerald Manley Hopkins)
(ক্যাম্ব্রিয়ানের প্রাণীগুলো বা হ্যালুসিজেনিয়া সম্পর্কে আরো অনেক তথ্য গুগলেই পেয়ে যাবেন)
Writer: Hassan Uz Zaman Shamol