জেন ইলিয়ট (Jane Elliott), একজন আমেরিকান স্কুল শিক্ষিকা - পরিচিত হয়ে আছেন তার বিখ্যাত "Blue eyes-Brown eyes" নামক এক অনুশীলনীর জন্য।
১৯৬৮ সাল। কোনো একদিন শ্রেণীকক্ষে এসে তিনি তার ছাত্র-ছাত্রীদের একটি অদ্ভুত কথা বললেন।
"শিক্ষার্থীরা, যেহেতু আমার চোখ নীল, তাই আমার মনে হয় নীল চোখের যারা আছো তারা অন্যদের থেকে আলাদা এবং তারা অবশ্যই অন্যদের থেকে বেশি সুযোগ সুবিধা পাওয়ার যোগ্যতা রাখো। তাই আজ থেকে আমি তোমাদের দুটি দলে ভাগ করে দিচ্ছি। প্রথম দলে থাকবে তারাই, যাদের নীল চোখ, এবং দ্বিতীয় দলে থাকবে যাদের বাদামি চোখ।"
ফলে তিনি তার ক্লাসের সকলকে দুটি দলে ভাগ করে দিলেন। প্রথম দল (নীল চোখের শিক্ষার্থীদের দল)-কে তিনি অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা দেওয়া শুরু করলেন, আর দ্বিতীয় দল (বাদামি চোখের শিক্ষার্থীদের দল)-কে সুযোগ সুবিধা দেওয়া তো দূরে থাক, তাদের নানা ভাবে ভর্ৎসনা করতে শুরু করলেন এবং তাদের সময়ে সময়ে মনে করিয়ে দিতে লাগলেন যে তারা বাদামি চোখের মানুষ, তাই তাদের সুযোগ সুবিধা পাওয়ার দরকার নেই।
কাজেই প্রায় সাথে সাথেই নীল চোখের ছেলেমেয়েরা বাদামি চোখের ছেলেমেয়েদের সাথে নানাভাবে খারাপ আচরণ করতে শুরু করলো। আর বাদামি চোখের ছেলেমেয়েরা তাদের সাথে এরকম আচরণের কারণে হতাশ হতে শুরু করলো, আস্তে আস্তে তাদের মনোবল ভেঙে যেতে শুরু করলো। এবং একইসাথে তারা প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমেও আস্তে আস্তে খারাপ করতে শুরু করলো।
হঠাৎ করেই এরপর জেন ইলিয়ট-এর মন কিভাবে যেন পুরোপুরি বদলে গেলো। তিনি ঘোষণা করলেন যে আসলে বাদামি চোখের শিক্ষার্থীরাই অন্যদের থেকে আলাদা এবং তাদেরই প্রকৃত সুযোগ সুবিধা পাওয়ার যোগ্যতা রয়েছে। কাজেই এতদিন যে সুযোগ সুবিধা নীল চোখের শিক্ষার্থীরা পেয়েছে, আজ থেকে সেই সুবিধা তারা পাবে না বরং বাদামি চোখের শিক্ষার্থীরা পাবে।
এরপর তিনি দ্বিতীয় দলকে প্রথম দলে পরিণত করলেন এবং প্রথম দলকে করে দিলেন দ্বিতীয় দল। বাদামি চোখের শিক্ষার্থীদেরকে তিনি বেশি সুযোগ সুবিধা দেওয়া শুরু করলেন এবং নীল চোখের শিক্ষার্থীদেরকে ভর্ৎসনা করা শুরু করলেন।
এবার বাদামি চোখের শিক্ষার্থীরা নীল চোখের শিক্ষার্থীদের সাথে খারাপ আচরণ শুরু করলো। নীল চোখের শিক্ষার্থীরা আস্তে আস্তে হতাশ হতে শুরু করলো।
শিক্ষিকা যখন এই পরীক্ষাটি বন্ধ করলেন, তখন প্রত্যেক শিক্ষার্থীরা একে-অপরকে জড়িয়ে ধরে নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করেছিলো এবং তারা বুঝতে পেরেছিলো যে কাউকে কখনো তার বাহ্যিক কোনো বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বিচার করা উচিত নয়।
১৯৫১ সালে ডক্টর সলোমন অ্যাশ (Dr. Solomon Asch - উচ্চারণ কি অ্যাশ, নাকি অ্যাশক? ) তার বিখ্যাত এই পরীক্ষাটি করেন।
তিনি প্রথমে কয়েকজন মানুষকে নিয়ে কয়েকটি গ্রুপ তৈরি করেন। একটি কাগজে ছোটবড় কয়েকটি সরলরেখা আঁকেন। প্রতিটি গ্রুপের সবাইকে আলাদা আলাদা ভাবে কাগজটি দেখিয়ে ছোট্ট একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন - কোন রেখাটি বড়?
কিন্তু সবগুলো গ্রুপেরই একটা বিশেষত্ব ছিল, প্রতিটি গ্রুপেই একজন বাদে বাকি সবাই সলোমন-এর নিজের লোক ছিল এবং তাদের বলে দেওয়া হয়েছিলো যে তারা যেন ইচ্ছে করেই ছোট রেখাটিকেই সিলেক্ট করে। বাকি লোকটি ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে তিনি এই বৈজ্ঞানিক ষড়যন্ত্রের শিকার, তিনি একদমই জানতেন না যে বাকি সবাই সলোমনের নিজের লোক এবং তারা ইচ্ছে করেই ভুল উত্তর দেবে।
পরীক্ষা শুরু হলো, একটি গ্রুপের কাছে গিয়ে গ্রুপের সবাইকে জিজ্ঞেস করা হলো কোন রেখাটি বড়। যথারীতি সবাই ছোট রেখাটিকেই বাছাই করলো। যখনই সেই খাঁটি লোকটিকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হলো, তখন দেখা গেল তিনি আমতা আমতা করছেন। তার পূর্বের প্রত্যেকে যে রেখাটিকে বাছাই করেছিলো, তিনিও সেটাকেই বড় রেখা বলে ভাবতে শুরু করেছেন, যদিও তিনি খুব ভালো করেই জানতেন যে এটা ভুল উত্তর। কিন্তু এতগুলো লোক যেহেতু ছোট রেখাটিকে সিলেক্ট করেছে, তাই তিনিও সবাই যেটা ভাবছে সেটাকেই ঠিক বলে মনে করতে শুরু করে দিয়েছেন।
এই পরীক্ষাটির মর্মার্থ হলো, যদি আপনি দেখেন যে অনেকগুলো লোক মিলে একটা ভুল কথা বলছে কিংবা ভুল কাজ করছে, তখন এটা ভুল জেনেও আপনি সেই ভুলটাকেই সঠিক বলে ভাবতে শুরু করে দেবেন। অন্তত একবার হলেও আপনার সন্দেহ হবে, এতগুলো মানুষ যখন বলছে বা করছে, সেটাই হয়তো ঠিক।
কি অদ্ভুত মানুষের মন তাই না?
এলিজাবেথ লোফটাস (Elizabeth Loftus) ও জন পামার (John Palmer), দুই সাইকোলজিস্ট, দু'জনে ১৯৭৪ সালে এক পরীক্ষা করেন। তাদের পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিলো, কোনো মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্ন করে তার স্মৃতি পরিবর্তিত করে দেয়া যায় কিনা।
কিছু মানুষকে দুটি গ্রুপে বিভক্ত করেন, তারপর তাদের ছোট ছোট কয়েকটা গাড়ি দুর্ঘটনার দৃশ্য দেখান। দুর্ঘটনাগুলো দেখানোর পর প্রত্যেককে কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন। প্রশ্নগুলোর প্রত্যেকটির অর্থ প্রায় একই, কিন্তু প্রশ্নগুলোত আলাদা আলাদা ক্রিয়াপদ ব্যবহার করেন তারা। যেমনঃ "About how fast were the cars going when they (smashed / collided / bumped / hit / contacted) each other?"
তারা দেখেন, একই প্রশ্ন, কিন্তু কিছু আলাদা ক্রিয়াপদ ব্যবহার করার কারণে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন উত্তর দিচ্ছে। যেসব প্রশ্নে তারা জোড়ালো অর্থসম্পন্ন ক্রিয়া ব্যবহার করেছেন, সেসব প্রশ্নের উত্তরও মানুষেরা কিছুটা রং চড়িয়ে দিচ্ছে। আবার হালকা অর্থের ক্রিয়াপদের প্রশ্নের উত্তরে তারা রং চড়াচ্ছে না, বরং যা ঘটেছিলো তার থেকে কমই বলছে।
এই পরীক্ষাটির মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, কিছু tricky প্রশ্নের মাধ্যমে আপনার স্মৃতির তথ্যগুলোকে অনেকাংশেই প্রভাবিত করা সম্ভব।
১৯৫৭ সালে, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে লিওন ফেস্টিঙ্গার (Leon Festinger) এবং জেমস কার্লস্মিথ (James Carlsmith) একটা পরীক্ষা করেন। কিছু মানুষকে নিয়ে করা এই পরীক্ষায় তারা মানুষগুলোকে কিছু খুবই বিরক্তিকর কাজ করতে দেন, যেমন ধরুন ১ ঘন্টা ধরে বসে বসে পেগ বোর্ডের পেগ ঘোরানো। প্রথম প্রথম তাদের মধ্যে খুবই বিরক্তি দেখা গেল। কাজগুলো করা হয়ে গেলে তাদেরকে ২০ ডলার দেয়া হলো এজন্য যে, তারা যেন বাহিরে গিয়ে অন্যান্য মানুষদের বিশ্বাস করায় কাজগুলো খুবই আনন্দদায়ক ছিল এবং তারা এতে একটুও বিরক্তি বোধ করেনি।
যথারীতি তারা বাহিরে গিয়ে বাকি মানুষদের বললো যে কাজগুলো করে তারা খুবই আনন্দ পেয়েছে। এরপর সেই বাকি মানুষদের ডেকে একই কাজগুলো করতে দেয়া হলো, আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেল, এই মানুষগুলো তেমন বিরক্তি বোধ করছে না। এদের কাজ করা হয়ে গেলে এদেরকে ১ ডলার দেয়া হলো।
এরপর পরীক্ষা শেষে সবার কাছে জানতে চাওয়া হলো যে এই কাজ করে তারা কিরকম আনন্দ কিংবা বিরক্তি অনুভব করছে। দেখা গেলো, যাদেরকে ২০ ডলার দেয়া হয়েছিলো, তারা খুবই বিরক্তি অনুভব করছে, কিন্তু যাদেরকে ১ ডলার দেয়া হয়েছিলো, তারা সত্যিই বিরক্তি অনুভব করেনি।
পরীক্ষাটির মর্মার্থ হলো, কোনো কাজ করতে মানুষ তখনই আনন্দ অনুভব করে, যখন সে বিশ্বাস করে কাজটি আসলেই আনন্দের। তার যদি মনে হয় কাজটি বিরক্তিকর, তাহলে সেই কাজটি যতই আনন্দের হোক না কেন তার কাছে সেটা বিরক্তিকরই লাগবে।
একই কথা পড়ালেখার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পড়ালেখা বেশিরভাগ মানুষের খারাপ লাগে কারণ তাদের মনে হয় এটা বিরক্তিকর, যদি তারা বিশ্বাস করতো পড়ালেখা বিরক্তিকর নয়, তবে তাদের বিরক্তি লাগতো না। কাজেই যাদের কাছে পড়ালেখা বিরক্তিকর লাগে, তাদের উচিত এমন কিছু বই পড়া, যেটা তাদের কাছে মজার বলে মনে হবে, যখন এ ধরণের বই পড়তে পড়তে বিশ্বাস হবে সত্যিই বই পড়া আনন্দের, তখন তারা আবিষ্কার করবে পড়ালেখা সত্যিই বিরক্তিকর নয়। এ ধরণের কোনো বইয়ের নাম যদি আমার কাছে কেউ জানতে চায়, তবে আমি বলবো মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের বিজ্ঞান, গণিত নিয়ে লেখা বইগুলো পড়ার জন্য। সেগুলো সুন্দর ভাষায় লেখা, হাই স্কুলের শিক্ষার্থীরা যেন বুঝতে পারে এরকম করে লেখা। এছাড়াও আরো অনেক লেখকের বই আছে। এগুলো পড়ে যখন তাদের ভালো লাগতে শুরু করবে, তখন স্কুল-কলেজের পড়ালেখাও আর বিরক্তিকর লাগবে না। (প্রমাণঃ আমি নিজে)
১৯৬৪ সাল। নিউ ইয়র্ক শহর। কিটি জেনোভেজ (Kitty Genovese), তার কাজ শেষে তার গাড়িতে করে নিজের বাড়িতে ফিরছিলেন। গাড়ি থেকে নেমে, গাড়ির দরজা বন্ধ করে তিনি তার এপার্টমেন্টের দিকে এগুলেন। হঠাৎ তিনি খেয়াল করলেন, একটি লোক তার দিকে আসছে। সে এসেই তাকে ধরে ফেলল এবং ছুরি দিয়ে আঘাত করলো। তিনি ভয়ার্তভাবে চিৎকার করলেন। ফলে একজন লোক সে চিৎকার শুনে সেই লোকটিকে ধমক দিয়ে সরিয়ে দিল। লোকটি কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে এলো, এসে কিটিকে আবারও আঘাত করলো। চিৎকার শুনে এবার আরো মানুষ দরজা খুললো, ফলে আততায়ী আবারও পালালো। কিন্তু না - সে আবারও ফিরে এলো এবং কিটিকে আবারও আঘাত করলো। কিটির প্রতিবেশী সহ প্রায় ৪০ জন লোক সেটি দেখলো, কিন্তু কারোরই মনে পড়লো না পুলিশকে ফোন করার কথা।
একজন লোক পুলিশকে ফোন করলো, কিটি মারা যাওয়ার পর।
ঘটনাটি বিখ্যাত হয়ে আছে এর "Bystander Effect" এর জন্যে। এর মানে হলো, কোনো ঘটনায় যত বেশি প্রত্যক্ষদর্শী থাকবে, তারা তত কম সেই ঘটনায় এগিয়ে গিয়ে সাহায্য করবে। কিটির হত্যাকাণ্ডেও একই ঘটনা ঘটেছিলো, সেখানে প্রায় ৪০ জন লোক ছিলো, যারা কিটিকে হত্যা করতে দেখেছে। কিন্তু কেউই পুলিশকে ফোন করেনি, কেননা প্রায় ৪০ জনই একসাথে হত্যাকান্ডটি দেখছিলো। এত বেশি প্রত্যক্ষদর্শী ছিল বলেই কিটির জীবনটি চলে গিয়েছিলো। হয়তো কিটি সে যাত্রায় বেঁচে যেত, যদি সেখানে আরো অনেক কম লোক থাকতো, সেক্ষেত্রে কেউ না কেউ পুলিশকে সাথে সাথে ফোন করার কথা চিন্তা করতো কিংবা নিজেই হয়তো এগিয়ে গিয়ে কিটিকে সাহায্য করতো।
১৯৬৭ সালে, মার্টিন সেলিগম্যান (Martin Seligman) একটি পরীক্ষা করেন। পরীক্ষাটি বিখ্যাত হয়ে আছে "Learned Helplessness Experiment" নামে।
কয়েকটি কুকুরকে নিয়ে, আলাদা আলাদা ছোট ছোট চেম্বারের ভেতর ঢুকিয়ে দেন, এরপর একটা ঘন্টা বাজিয়ে কুকুরগুলোকে হালকা বিদ্যুতিক শক দেন। কয়েকবার এভাবে শক দেওয়ার পর দেখা গেল কুকুরগুলো ঘন্টা শোনার সাথে সাথেই এমন আচরণ শুরু করলো যেন তাদের শক দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তখনও তাদের শক দেওয়া হয় নি।
কিন্তু এ পরীক্ষা হতে এক আশ্চর্যজনক ফলাফল পাওয়া গেলো।
কুকুরগুলোকে এমন চেম্বারে রাখা হয়েছিলো, যার ঠিক মাঝামাঝিতে একটা ছোট বেড়া দিয়ে চেম্বারকে দুইটি ভাগে ভাগ করা ছিল। বেড়াটি ছোট ছিল, যাতে কুকুর চাইলেই সেই বেড়ার ওপর দিয়ে লাফ দিয়ে চেম্বারের অন্য পাশে চলে যেতে পারে। বেড়ার এই পাশের অংশের ফ্লোরটি ছিল বিদ্যুতায়িত, যার মাধ্যমে কুকুরকে শক দেওয়া হতো, কিন্তু বেড়ার অন্য পাশের ফ্লোর সাধারণ ছিল, সেখানে কোনো কারেন্ট ছিল না।
কয়েকবার শক দেওয়ার পর দেখা গেল, কুকুর শক পেয়ে বেড়া ডিঙিয়ে অন্য পাশে যাচ্ছে না। বরং যেখানে ছিল সেখানেই শুয়ে পড়ছে। অথচ অন্য পাশে গেলেই সে আর শক পাবে না।
এই পরীক্ষাটি থেকে সেলিগম্যান বুঝতে পারলেন, প্রথম কয়েকটি পরীক্ষায় শক দেওয়ার সময় কুকুর কিছু করতে পারে নি, তাই সে নিজেকে সাহায্যহীন ভাবতে শুরু করেছে, মনে করছে আগের শকের সময় সে কিছু করতে পারে নি বলে এখনও কিছু করতে পারবে না।
বিষয়টি সম্পর্কে আরো পরিষ্কার হওয়ার জন্য তিনি আরো কিছু প্রাণী নিয়ে পরীক্ষা করলেন, দেখা গেল, যাদেরকে আগে শক দেওয়া হয় নি, তারা শক পেয়েই অন্য পাশে লাফ দিচ্ছে। কিন্তু যাদেরকে আগে শক দেওয়া হয়েছে, তারা লাফ দিচ্ছে না, তারা নিজেদের "Helpless" ভাবতে শুরু করে দিয়েছে।
পরীক্ষাটি থেকে স্পষ্ট হয় যে, মানুষ কিংবা পশু, যেই হোক, তাদের সাথে পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে শিক্ষালাভ করে, এবং পূর্বের ঘটনায় যদি সে বাঁচার কোনো পথ বের না করতে পারে, তবে সে নিজেকে সাহায্যহীন ভাবতে শুরু করে এবং হতাশ হয়ে পরবর্তীতে হাল ছেড়ে দেয়।
১৯৯৯ সালে ড্যানিয়েল সিমনস (Daniel Simons) ও ক্রিস্টোফার ক্যাব্রিস (Christopher Chabris) হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে একটা ছোট্ট পরীক্ষা করেন।
কিছু মানুষকে একটি ভিডিও দেখতে বলেন, সেটা ছিল একটি বাস্কেটবল খেলার ভিডিও। তাদের বলা হয়েছিলো, তারা যেন এই খেলায় সাদা দল কতোবার বল পাস করে সেটা গোনে।
সাধারণ গতিতে চলা এই ভিডিওতে কতবার বল পাস হচ্ছে তা গোনা খুবই সহজ কাজ, তারা ভালোভাবেই কোনো কষ্ট ছাড়াই গুণছিলেন। কিন্তু এই গোনার সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বেশিরভাগ লোক খেয়ালই করলেন না। সেই ভিডিওর মাঝামাঝি সময়ে দেখা যায়, একটা গরিলার পোশাক পড়া লোক, খেলা চলাকালীন সময়েই কোর্টের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে, কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে সে চলে যায়। কিন্তু বল পাস গুনতে থাকা বেশিরভাগ লোক এই গরিলাম্যানকে দেখতেই পান নি।
পরীক্ষাটি দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কোনো মানুষকে কোনো কাজ করতে বলা হলে এবং সে সেই কাজ করা শুরু করলে, সেই কাজে একসময় সে এতই মশগুল হয়ে পড়ে যে সে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও মিস করে ফেলতে পারে।
জন ওয়াটসন (John B. Watson) এবং রোজালি রায়নার (Rosalie Rayner)- এর করা এই পরীক্ষাটি সবচেয়ে অনৈতিক সাইকোলজিক্যাল পরীক্ষাগুলোর একটা বলে বিবেচনা করা হয়।
একটি ৯ মাস বয়সী শিশুর সামনে একটি সাদা ইঁদুর ছেড়ে দেন তারা। প্রথম দিকে শিশুটির ইঁদুরটির প্রতি কোনো ভয়-ভীতিই ছিলো না। কিন্তু এরপরে যখনই তার সামনে ইঁদুর ছাড়েন, তখন একটা স্টিলের পাতে হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি দিয়ে এক ভয়ংকর শব্দও সৃষ্টি করেন। কাজেই শিশুটি যখনই ইঁদুর দেখতো, তখন শব্দের কারণে প্রচন্ড ভয়ও পেতো। কয়েকবার এরকম করার পর শিশুটি কেঁদে দেয়, এবং এরপর থেকে শিশুর মনে এক ভয় সৃষ্টি হয়। সে এরপর থেকে যখনই ইঁদুর দেখে, তখনই খুব ভয় পেতে শুরু করে, কোনো শব্দ সৃষ্টি না করা সত্বেও।
এই পরীক্ষার গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত হলো, কোনো বয়স্ক মানুষের বেশিরভাগ ভয়ই আসলে তার শিশুকালের কোনো ঘটনা থেকে সৃষ্টি হয়ে থাকে।
এই পরীক্ষাটি কোনো সাইকোলজিস্ট করেন নি। বরং করেছিলেন পৃথিবীর একজন সেরা বেহালাবাদক, জশুয়া বেল (Joshua Bell)।
২০০৭ সাল, ওয়াশিংটন ডি.সি., এক পাতাল রেল স্টেশনে জশুয়া বেল এসেছিলেন ভিখিরীর বেশে। তিনি যে বেহালা নিয়ে এসেছিলেন, সেটা ছিলো অত্যন্ত দামি বেহালা, সেই বেহালায় তিনি যে সুর তুলেছিলেন, সেটা ছিলো পৃথিবীর অন্যতম সেরা সুর এবং সেই সুর শোনার জন্য মানুষ হাজার হাজার ডলার ব্যয় করে তার অনুষ্ঠানে যেত।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, তিনি সে স্টেশনে ৪৫ মিনিট দাঁড়িয়ে তার বেহালা বাজিয়ে গেলেন, কিন্তু কেউ তার দিকে তাকালোও না, শুধুমাত্র ৬ জন মানুষ ব্যতীত। যার বেশিরভাগই ছিলো শিশু। কিন্তু মায়েরা তাদের সেই সুর শুনতে দিচ্ছিলেন না, রাস্তার ভিখিরীর সুর শোনার জন্যে কোনো আগ্রহ বোধ করছিলেন না তারা। সেই ৪৫ মিনিট বেহালা বাজিয়ে তিনি ৩২ ডলার ভিক্ষা পেলেন, যারা দিয়েছিলো তারা দাঁড়ায় নি, বেহালার সুর শোনেনি, যেভাবে হেঁটে যাচ্ছিলো, সেভাবেই ভিক্ষা দিয়ে চলে গেল।
এই পরীক্ষাটি সাইকোলজির জগতে সবচেয়ে আলোচিত পরীক্ষাগুলোর মধ্যে অন্যতম।
যিনি এই পরীক্ষাটি করেন তার নাম ফিলিপ জিমবার্ডো (Philip Zimbardo), একজন সাইকোলজির প্রফেসর। ১৯৭৩ সালে করা এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিলো, জেলখানায় গার্ডরা কয়েদিদের ওপর নির্যাতন কেনো চালায় তা জানা। এটা কি গার্ডদের মন-মানসিকতার কারণে, নাকি জেলখানার পরিবেশের কারণে, নাকি অন্য কোনো কারণে?
উত্তর জানার জন্য তিনি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সাইকোলজি বিভাগের বিল্ডিংয়ের একটা জায়গাকে জেলখানা বানিয়ে ফেললেন। খুব ভালোমতো যাচাই বাছাই করে শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ ২৪ জন শিক্ষার্থীকে দুটি দলে ভাগ করলেন (এই ২৪ জনের মধ্যে কেউই কাউকে চিনতো না)। এক দল থাকবে কয়েদির ভূমিকায়, আরেকদল গার্ডের ভূমিকায়। তাদের সেই বানানো জেলখানায় দুই সপ্তাহ থাকতে হবে, ঠিক সত্যিকারের জেলখানার গার্ড আর কয়েদির মতো করে।
তো পরীক্ষা শুরু হলো। গার্ডদের গার্ডের পোশাক, আর কয়েদিদের কয়েদির পোশাক, পায়ে শিকল ইত্যাদি পড়ানো হলো। এরপর তাদের জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হলো। আর শিক্ষার্থীরা সবাই যার যার নিজের ভূমিকায় অভিনয় করতে শুরু করলো।
দেখতে দেখতে গার্ডের ভূমিকায় থাকা শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠলো নিষ্ঠুর, তারা কয়েদিদের ভূমিকায় থাকা শিক্ষার্থীদের সত্যি সত্যি কয়েদি ভাবতে শুরু করলো, আর শুরু করলো তাদের ওপর নানারকমের নির্যাতন। আর কয়েদির ভূমিকায় থাকা শিক্ষার্থীরা তাদের ওপর এই নির্যাতনের কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে শুরু করলো, তারা নিজেরাও নিজেদেরকে অসহায় কয়েদি বলেই ভাবতে শুরু করলো। আর গার্ডদের অকথ্য গালিগালাজ, অপমান এমনকি শারীরিক নির্যাতনও ভোগ করতে শুরু করলো। ফলে ৬ দিনের মাথায় এই পরীক্ষা বন্ধ করে দিতে হলো।
এ পরীক্ষা থেকে সাইকোলজিস্টরা বুঝতে পারলেন কয়েদি আর গার্ডদের এরূপ আচরণের কারন আসলে ভিন্নরকম সিচুয়েশনের মুখোমুখি হওয়া। মানুষের আচরণ হঠাৎ করেই বদলে যেতে পারে, সে যেরকম সিচুয়েশনের মধ্যে আছে তার ওপর নির্ভর করে।
জুলাই, ১৯৬১-তে স্ট্যানলি মিলগ্রাম (Stanley Milgram) খবরের কাগজে এক বিজ্ঞাপন দেয়ার মাধ্যমে ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং আলোচিত পরীক্ষাটির সূচনা করেন।
খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেন- ছাত্র এবং শিক্ষক সংক্রান্ত একটি পরীক্ষার উদ্দেশ্যে দুইজন স্বেচ্ছাসেবক প্রয়োজন। আগ্রহীরা যেন যোগাযোগ করেন।
তো সেই বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেই পরীক্ষায় অংশ নিতে এলেন, মিলগ্রাম তাদের মধ্যে থেকে দুইজনকে বাছাই করে নিলেন। এই দুইজনের মধ্য থেকে একজন হবেন শিক্ষক, আরেকজন ছাত্র। লটারির মাধ্যমে দুইজনের মধ্য থেকে একজনকে শিক্ষক, আরেকজনকে ছাত্র নির্বাচন করলেন। এরপর শিক্ষক এবং ছাত্র উভয়কেই পরীক্ষার উদ্দেশ্য এবং কিভাবে পরীক্ষাটি হবে তার সমস্তকিছু সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বললেন।
প্রথমে ছাত্রটিকে কিছু জোড়া শব্দ মুখস্থ করতে বললেন, পরীক্ষার সময় এই জোড়া শব্দগুলোর একটি জিজ্ঞেস করা হলে ছাত্র তার জোড়ার শব্দটা বলবে। শিক্ষককে একটি বিশেষভাবে তৈরি যন্ত্র দিলেন, যেটার মাধ্যমে ৪৫ ভোল্ট থেকে ৪৫০ ভোল্ট পর্যন্ত ইলেকট্রিক শক দেওয়া যায়। এটা দিয়ে ছাত্রকে শক দেওয়া হবে।
পরীক্ষার উদ্দেশ্য হলো, ইলেকট্রিক শক দিয়ে আরো দ্রুত শেখানো যায় কিনা তা পরীক্ষা করা। শিক্ষক ছাত্রকে সেই শব্দগুলোর মধ্য থেকে কোনোটি জিজ্ঞেস করবে, ছাত্রকে তার জোড়ার শব্দ বলতে হবে। যদি সঠিক উত্তর দিতে পারে তো ভালো, আর না পারলে তাকে ইলেকট্রিক শক দেবেন শিক্ষক। একদম শুরুতে ৪৫ ভোল্টের শক। এবং প্রতিবার শক দেওয়ার সাথে সাথে শকের মাত্রা ১৫ ভোল্ট বাড়িয়ে দিতে হবে। এভাবে ১৫ ভোল্ট করে বাড়াতে বাড়াতে ৪৫০ ভোল্টে গিয়ে শেষ হবে।
যদিও ৪৫ ভোল্টের শক তেমন কিছু না, কিন্তু ৪৫০ ভোল্ট একটা ভয়ংকর বিষয়, মেরে ফেলার মতো অবস্থা।
তাদের এটাও বলে দেওয়া হলো যে- পরীক্ষা একবার শুরু হলে, একদম শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাঝপথে কেউ পরীক্ষা বন্ধ করতে পারবে না।
ছাত্র এবং শিক্ষক দুজনেই রাজি হয়ে গেল পরীক্ষাটি করার জন্য।
কাজেই ছাত্রটিকে এরপর একটি রুমে একটি বিশেষ চেয়ারে বসিয়ে দিলেন মিলগ্রাম। আর শিক্ষক বসলেন তার পাশের রুমে। ছাত্রকে চেয়ারে রীতিমতো বেঁধে ফেলে তার শরীরে ইলেকট্রিক শক দেওয়ার জন্য তার লাগিয়ে দিলেন।
এরপর শুরু হলো পরীক্ষা। শিক্ষক একটা একটা করে প্রশ্ন করেন, ছাত্র উত্তর দেন। প্রথম প্রথম কয়েকবার ঠিক ঠাক উত্তর দিলেন ছাত্র। কিন্তু এরপর থেকে আস্তে আস্তে ভুল করতে শুরু করলেন, আর শিক্ষক তাকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে সাথে সাথে শকের মাত্রা ১৫ ভোল্ট করে বাড়াতে লাগলেন। ব্যাপারটা ভয়াবহ অবস্থায় পরিণত হলো কিছুক্ষন পর। ছাত্র ভুল উত্তর দিলেই শিক্ষক তাকে শক দেন এবং সেই শক খেয়ে ছাত্র আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করতে থাকেন।
শিক্ষক বিষয়টাকে সহ্য করতে পারছিলেন না, তাই তিনি চারবার মিলগ্রামকে গিয়ে অনুরোধ করেন এই পরীক্ষা বন্ধ করার জন্য, কিন্তু মিলগ্রাম প্রতিবারই তাকে "এই পরীক্ষাটিতে আপনার সহায়তা খুবই প্রয়োজন", "এই পরীক্ষাটি আপনাকে শেষ করতেই হবে" ইত্যাদি বলে শিক্ষককে পরীক্ষাটি শেষ করার জন্য বলতে লাগলেন। কাজেই শিক্ষক শেষ পর্যন্ত পরীক্ষাটি চালিয়ে গেলেন। শেষ মুহূর্তে ভোল্টেজের মাত্রা এত বেড়ে গেলো যে ছাত্র বেচারা অজ্ঞান হয়ে গেলো, তবুও পরীক্ষা বন্ধ করতে দেওয়া হলো না।
আমি জানি প্রত্যেকেই এখন ভুরু বাঁকা করে ভাবছে বিজ্ঞানী হয়ে কিভাবে এরকম এক অমানুষিক বেআইনি পরীক্ষা করতে পারলেন? কিন্তু মজার বিষয়টা হলো, এই পরীক্ষাটি পুরোটাই এক ধোঁকা। এই পরীক্ষাটির উদ্দেশ্য আদতেই শক দিয়ে পড়ালেখা করানো নয়, বরং এই পরীক্ষার আসল উদ্দেশ্য ছিলো একজন ধোপদুরস্ত বিজ্ঞানী চেহারার লোক একজন সাধারণ মানুষকে কোনো অনৈতিক কাজ করার আদেশ করলে সে সেই আদেশ কতটুকু মানে, এবং সেই আদেশ মেনে সে কতদূর পর্যন্ত সেই কাজ করে যেতে পারে- তা জানা। সত্যিকার অর্থে ছাত্রটি ছিলো মিলগ্রামের নিজস্ব লোক, তাকে কোনো শকই দেওয়া হয় নি, সে শুধু শক খাওয়ার অভিনয় করে যাচ্ছিলো, কিন্তু শিক্ষক এইসবের কিছুই জানতেন না, তিনি ভেবেছিলেন সবই সত্যি।
মিলগ্রাম এই পরীক্ষা আরো অনেক বার করেছিলেন। তার পরীক্ষার ফলাফল ছিলো, ৬৫% লোক পরীক্ষাটি সম্পূর্ণ শেষ করেছিলেন, আর ১০০% লোকই অন্তত ৩০০ ভোল্ট পর্যন্ত গিয়েছিলো।
সারাংশঃ আপনি নিজেকে যতটা অনুগত ভাবেন, আপনি তার চেয়েও বেশি অনুগত। এবং আপনার সেই আনুগত্য আরো বেশি ফুটে উঠবে যখন কোনো ধোপদুরস্ত চেহারার লোক আপনাকে কোনো আদেশ করবে।
[সমাপ্তি]
লিখাঃ সোহানূর রহমান সৌমিক
Tags:
Phychology