হার্ট এর কাজ ও এর গঠন সর্ম্পকে ডাক্তার ছাড়া সাধারন মানুষের জানার কথা নয়। কিন্তু প্রত্যেক মানুষের এ সম্পর্কে কিছুটা সাধারন বিষয় জানা থাকলে অনেক সময় নিজেরাই চিকিৎসার ব্যাপারে ভাল সিদ্ধান্ত দিতে পারে। হার্টের ব্লকেজ কি এটি সর্ম্পকে জানার জন্য হার্ট এর কাজ ও গঠন নিয়ে সাধারন কিছু আলোচনা করা যাক। হার্ট হচ্ছে বিশেষ ধরনের মাংশপিন্ড যা জন্ম থেকে প্রসারন ও সংকোচন এর মাধ্যমে পুরো দেহের রক্ত সঞ্চালন কাজ এ নিয়োজিত রয়েছে। যে মুহূর্তে হার্ট এ কাজ বন্ধ করবে সে মুহূর্তেই দেহের রক্ত সঞ্চালন কাজ বন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটে। হার্টের এ সংকোচন ও প্রসারন ক্ষমতা কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া দুটিই হার্টের সমস্যা বলে বিবেচিত হবে আর এর উপসর্গ হিসাবে প্রথমে ধরা পড়বে উচ্চ রক্তচাপ বা নিম্ন রক্তচাপ। হার্ট ব্লকেজ হলে প্রথমে 'উচ্চ রক্তচাপ' অভিযোগ শুরু হয়। ধীরে ধীরে বুক ব্যথা , শ্বাসকষ্ট এর আভিযোগটা স্পষ্ট হয়। ব্লকেজের অবস্থান ও পরিমানের উপর নির্ভর করে হার্ট এটাকের ঝুঁকি।
হার্ট ব্লকেজ বলতে বোঝানো হয় , করোনারী আর্টারী ব্লকেজ। করোনারী হচ্ছে ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ ' হার্ট '। আর্টারী (ধমনীর ল্যটিন শব্দ) দেহের রক্ত সঞ্চালন পথ যা লম্বা করলে প্রায় ১ লক্ষ মাইল হবে। হার্ট থেকে যা শুরু হয়ে দেহের চর্মে এসে শেষ হয়েছে। করোনারিআর্টারী হচ্ছে ,হার্টের নিজস্ব রক্ত সরবরাহকারি পথ। হার্ট প্রতি মিনিটে ৭০/৭২ বার সংকোচিত হয় এর ফলে ৫/৬ লিটার রক্ত মহাধমনী পথে নিক্ষেপ করে। মহাধমনীর একটি শাখা হৃদপিন্ডে প্রবেশ করে আর এটিকেই বলে করোনারি আর্টারী। করোনারি আর্টারী পথের যে কোন অবরোধকেই বলা হয় 'করোনারি আর্টারি ব্লকেজ'। এ ধমনি পথ হৃদপিন্ডে প্রবেশের পর যতই দূরে ভিতরে প্রবেশ করল ততই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে জালিকার মত পুরো হৃদপিন্ডকে আকড়েঁ রেখে প্রতি মুহূর্তের রক্ত সঞ্চালন কে নিশ্চিত করে। এ রক্ত এর মাধ্যমে পুরো দেহে অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছে যায়। আক্সিজেন ও পুষ্টি ছাড়া দেহ অঙ্গ বাঁচে না। কম হলে সঠিক ভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না। হৃদপিন্ডে খুব বেশী অক্সিজেন ও পুষ্টি দরকার হয়। কারন হৃদপিন্ডকে বিরতিহীন ভাবে কাজ করতে হয়। সুতরাং হৃদদেহের রক্ত সরবরাহ নালী যদি সরু হয় বা বন্ধ থাকে তবে তা হৃদপিন্ডের সংকোচন ও প্রসারন কে ব্যহত করবে এটিই স্বাভাবিক। শুধু তা নয় এর জন্য মৃত্যু ঝুঁকি তো রয়েছেই। এনজিওগ্রাম করে হৃদপিন্ডের রক্ত সঞ্চালন পথে কোন অবরোধ আছে কি না দেখা যায়। যদি অবরোধ থাকে তবে ডাক্তারগন গুরুত্ব বিবেচনা করে 'রিং' বা ' বাইপাস' করানোর পরামর্শ দেন। দুটোরই এক্ই উদ্দেশ্য যেন ব্লকেজের কারনে হৃদযন্ত্রে রক্তসরবরাহ বিঘ্ন না ঘটে। রিং (স্টৈন্ট) হচ্ছে স্টিলের তৈরি পেচানো রড যেটি ধমনির অবরোধ অংশে স্থাপন করা হয়। বাইপাস হচ্ছে দেহের অন্য স্থান বিশেষ করে পায়ের কাছ থেকে ধমনী কেটে এনে হৃদপিন্ডে বিকল্প রক্ত সঞ্চালন পথ স্থাপন করা হয়।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে দেহের রক্ত সঞ্চালনকারি নালির মোট দৈর্ঘ প্রায় পৌনে 2 লাখ কিলোমিটার। যদি এ পথে ব্লকেজ তৈরি হতেই থাকে তবে 'রিং' বা 'বাইপাস ' করে আদো বাঁচা যায় কি্? বিশাল রক্ত সঞ্চালনকারি পথ যদি নিজস্ব নিয়মে অবরোধ মুক্ত না থাকে তবে 'রিং' বা ' বাইপাস করে্ একে অবরোধ মুক্ত রাখা আদো সম্ভব কি? এক কথায় রিং বা বাইপাস একবারেই প্রয়োজন নেই যদি দেহের নিজস্ব রক্ত সঞ্চালন পথ অবমুক্ত রাখার ক্ষমতাকে ফিরিয়ে দেয়া যায়। আর এটি যদি পুর্নস্থাপিত না হয় অন্য কোন পদ্ধতিই বাঁচিয়ে রাখার জন্য কাজ করবে না। সুতরাং দেহের এ প্রক্রিয়া কাজ করে বলেই দু একটা রিং বা বা্ইপাস সফল হয়।
ধমনীর শেষ প্রান্ত কে ক্যাপিলারী বলে।এটি এত চিকন রক্ত নালিকা যে মাত্র একটি রক্ত কনিকা যেতে পারে।যার আয়তন ৭ মিলিমাইক্রোন। একটি চুলের আয়তন ১৭ মিলিমাইক্রোন (১মাইক্রোন, ১মিটারের ১০ লক্ষ ভাগের এক ভাগ। রিং (স্টেন্ট) এর গড় দৈর্ঘ্য ১৫.৮৩মি:মি: হতে ১৬.৪৫ মি:মি: এবং এর গড় আয়তন ২.৪৯ মি:মি হতে ৩.০০ মি:মি: ১ মাইক্রোন,১মি:মি: এর ১০০০ ভাগের ১ভাগ)) । ধমনির শেষ প্রান্ত যেখানে শেষ হয়েছে,শিরার উপত্তি সেখানে শুরু হয়েছে।শিরা হচ্ছে অন্য ধরনের রক্তনালী যারা ধমনির মাধ্যমে বয়ে নিয়ে যাওয়া রক্তকে আবার শিরা ,উপশিরা হয়ে মহাশিরা পথে হৃদপিন্ডে ফিরিয়ে আনে।
হৃদপিন্ড প্রতি মিনিটে পাম্প করে ৫/৬ লিটার রক্ত মহাধমনী পথে ছুঁড়ে দেয় এবং দেহের শেষ প্রান্তে এ রক্ত পৌঁছে শিরায় প্রবেশ করে এবং উপশিরা , মহাশিরা পথে ১ মিনিট সময়ের মধ্যে হার্টে ফিরে আসে।এ এক মিনিট সময়ের মধ্যে ৫/৬ লিটার রক্ত ১ লাখ মাইল প্রায় পৌনে 2 লাখ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে।হার্ট প্রতি মিনিটে প্রায় এর ৫ গুন (৩০ থেকে ৩৫ লিটার ) রক্ত সঞ্চালন করার ক্ষমতা রাখে। হার্টের এই অসাধারন ক্ষমতার জন্যই খেলোয়াররা দৌঁড়াতে পারে।হৃদপিন্ডের এ ক্ষমতা পর্যবেক্ষন করে বিজ্ঞানিরা রীতিমত অবাক।হার্ট যদি মাত্র ১ মিনিট কাজ বন্ধ করে তা হলে একজনের মৃত্যু ঘটতে পারে ,১ ঘন্টা তো অনেক সময়।হার্টের সমস্যা নিয়ে রোগীরা বছর এর বছর বেঁচে থাকে। রিং বা বাইপাস করে সব কৃতিত্ব ও সালাম আধুনিক চিকিৎসা ও চিকিৎসক কে দিচ্ছে। এটা কিভাবে সম্ভব হচ্ছে ?
রক্তনালির (ধমনী , শিরা ) ভিতরের স্তর 'এন্ডোথেলিয়াম ' নামক বিশেষ কোষ দিয়ে তৈরি।প্রান্তিক দিকের রক্তনালি পথ গুলো এক স্তর বিশিষ্ট এন্ডোথেলিয়াম কোষ। সুস্থ্য এন্ডোথেলিয়াম কোষের কাজ হচ্ছে, রক্তনালি পথ গুলোকে পরিষ্কার রাখা এবং যে কোন ধরনের আঘাত (যেমন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস , ফাঙ্গাস, বিষাক্ত ক্যমিকেল ) থেকে রক্তনালি পথকে রক্ষা করা। শুধু তাইই নয় যদি কোন রক্তনালি আঘাত প্রাপ্ত হয় সাথে সাথে সাড়িয়ে তোলার কাজ করার পাশাপাশি , রক্ত সরবরাহে যাতে বিঘ্ন না ঘঠে এ জন্য নতুন করে রক্তনালিকা তৈরি করে রক্ত চলাচল নিশ্চিত করে। প্রতি মুহূর্তে পৌনে ২ লাখ রক্তনালি পথে নানা ধরনের ভাঙ্গা গড়ার কাজ চলে। শুধুমাত্র সুস্থ্য সবল এন্ডথেলিয়াম এর কারনে প্রতি মুহূর্তের বিপর্যয় সবাই বেঁচে যাই। র্দুঘটনায় থেতলে যাওয়া দেহ একই কারনে নতুন করে পুর্নঘটিত হয়। ডাক্তার শুধু ব্যান্ডেজ করে ব্যকটেরিয়া প্রতিরোধ করে যাতে ক্ষত না হয়। কারন উন্মক্ত ক্ষতে ব্যকটেরিয়ার আক্রমন বেশী হয়। লিভার 'প্লাজমিনেজেন' নামে একটি প্রোটিন তৈরি করে। যেটি টহল পুলিশের মত কাজ করে। যখনেই রক্তনালি পথে কোন দানা বাঁধে (ক্লট) সাথে সাথে এটি ভেঙ্গে দিয়ে রক্ত চলাচল উন্মুক্ত করে দেয়।
রক্তের কোলেষ্টেরল জমে গিয়ে নালিপথ চিকন ও বন্ধ হতে পারে। কোলেষ্টরল দেহের অতি প্রয়োজনীয় জীবরসায়ন যা তৈরি না হলে মৃত্যু হতে পারে। এটিও লিভার তৈরি করে রক্তস্রোতে ছেড়ে দেয় । অব্যবহৃত কোলেষ্টরল পুনরায় লিভারে ফিরে আসে। লিভারে ফিরে আসার কৌশলটি নষ্ট বা বন্ধ খাকলে রক্তসোতে ভেসে বেড়ায় এবং নালি গাত্রে থিতিয়ে পড়ে গাত্রপথকে সরু বা বন্ধ করে দেয়।
করোনারি আর্টারি ব্লকেজে 'রিং' বা 'বাইপাস সার্জারী' সাথে সাথে আজীবন যে ড্রাগগুলি ব্যবহারে প্রেসক্রাইব করা হয় সে গুলোর কার্যকারিতা নিয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো।
বিশ্বজুড়ে কার্ডিয়াক ডাক্তারগন যে ড্রাগ গুলো লিখেন সে গুলো হলো : বিটা ব্লকার : এ ড্রাগটি দেহের জন্য অতি জরুরী কিডনি গ্ল্যান্ডে উৎপাদিত একটি হরমোন 'এড্রেনালিন' কে হৃদপিন্ডে আসতে বাঁধা দেয়। ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার (এমলোডিপিন) এ ড্রাগটি হৃদপেশী কোষে ক্যালসিয়াম প্রবেশে বাঁধা দেয়। ক্লোপ্রিডেোগেল ও এসপিরিন , ওয়ারফেরিন, হেপারিন রক্তকে পাতলা রাখতে ব্যবহার হয়। এনজিওটেনসিন ২ ইনহিবিটর ও ফ্রসেমাইড .ইউরিন এর পরিমান বাড়িয়ে দেয়। এটরভাসটাটিন ,লিভারের কোলেষ্টরল তৈরিতে বাঁধা দেয়। এ জেনেরিক নামের ড্রাগ গুলো বিশ্বের ড্রাগ কোম্পানিগুলো বিভিন্ন নামে বাজারজাত করে। এ ড্রাগ গুলোর কাজের কৌশল মূল্যায়ন করলে দেখবেন একটি পদ্ধতিও "করোনারি আর্টারি ব্লকেজ' নিরাময়ের সাথে সম্পর্ক নেই। শুধুমাত্র সঠিক প্রকৃতিক খাদ্য ব্যবস্থাপনা ও জীবন ব্যবস্থাই স্বুস্থ্য সবল হাটের গ্যারান্টি দিতে পারে।
Written by: Dr. Shebendra Karmar
Honorary Ph.D, IUM-USAIUM-USA's Representative in Bangladesh & Helen